সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

‘গুম’ হয়ে যাওয়ার বিভীষিকা ও বাংলাদেশের বিপদ

স্বাধীন দেশে জননিরাপত্তাহীনতার বেহাল চিত্র


॥ ফরহাদ মজহার ॥ 

বিএনপির নেতা, সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী এখনো ‘গুম’ রয়েছেন। আজ ২৩ এপ্রিল তার জন্য বিএনপির দ্বিতীয় দিনের হরতাল চলছে। যদি ইলিয়াস ছাড়া না পান তাহলে এই হরতাল লাগাতার চালানো হবে বলে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে আরো অনেকে গুম হয়েছেন। তারা সাধারণ নাগরিক। মানবাধিকার কর্মীরা এর বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সোচ্চার ছিলেন। এতে ‘গুম’ হয়ে যাবার বিভীষিকা মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে। ইলিয়াস আলী একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতা। তিনি ‘গুম’ হয়েছেন বলে ‘গুম’ ব্যাপারটি এখন একটি দলীয় রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন তাঁর নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথে পুলিশ ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে দুইজন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন বলে সংবাদ পেয়েছি। বাংলাদেশ আবার দ্রুত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার দিকে এগিয়ে গেল।
মানবাধিকারের দিক থেকে নিখোঁজ হওয়া আর গুম হওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। ইলিয়াস আলীর পরিত্যক্ত গাড়ি বনানীতে পাবার পরপরই অভিযোগ উঠেছিল তিনি নিখোঁজ হন নি, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। সরকার যথারীতি অস্বীকার করেছে কিম্বা যেভাবে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে সরকারের অবগতির মধ্যেই ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযোগ। শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, বিএনপিই তাকে লুকিয়ে রেখেছে। তাঁর এই মন্তব্যে সরকারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আরো গাঢ় হয়েছে মাত্র। ফলে তিনি হারিয়ে যান নি বা নিখোঁজও নন। ‘গুম’ হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি ‘গুম’ হয়েছেন। এই চুক্তির নাম ‘গুম হওয়া থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি’ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়হাবহঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব চৎড়ঃবপঃরড়হ ড়ভ অষষ চবৎংড়হং ভৎড়স ঊহভড়ৎপবফ উরংধঢ়ঢ়বধৎধহপব)। ‘গুম’ মানে এখানে জবরদস্তি কাউকে নিখোঁজ করে ফেলাÑ ‘এনফোর্সড ডিঅ্যাপিয়ারেন্স’। এই চুক্তি অনুযায়ী ‘গুম’ হওয়া মানে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়া নয় কিংবা কোন অপরাধী বা অপরাধী চক্র অপহরণ করলে এবং কাউকে খুঁজে না পেলে সেটাও এই কনভেনশান অনুযায়ী ‘গুম’ হবে না। আক্ষরিক অর্থে তাকে ‘গুম’ বলায় অসুবিধা নাই। কিন্তু এই কনভেনশান অনুযায়ী ‘গুম’ বলার সঙ্গে তার পার্থক্য মনে রাখতে হবে। এই আক্ষরিক অর্থে ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ‘গুম’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশানের বিবেচনার মধ্যে পড়বে না।
কনভেনশানের উদ্দেশ্য অনুযায়ী তাকেই ‘গুম’ বোঝাবে যদি রাষ্ট্রের কোনো এজেন্ট, কিম্বা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে, সমর্থন পেয়ে বা মৌন সম্মতিতে কাউকে বিনা বিচারে আটক, অপহরণ বা অন্য কোন উপায়ে তার স্বাধীনতা হরণ করে, তারপর সেই ব্যক্তিকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তা অস্বীকার করে অথবা সেই ব্যক্তির কী দশা হোল বা সে কোথায় আছে তা লুকায় আর এইভাবে তাকে আইনের সুরক্ষার বাইরে স্থাপন করে। এই সংজ্ঞার সারকথাÑ ‘আইনের সুরক্ষার বাইরে কাউকে স্থাপন’ করার বিরোধিতার মধ্যে। এটাও লক্ষ্য করবার বিষয় যে রাষ্ট্র বা সরকারকে এই ক্ষেত্রে সরাসরি কোন নির্দেশ দিতে হবে এমন কোন কথা নাই। রাষ্ট্রের মৌন সম্মতিই (ধপয়ঁরংধহপব) যথেষ্ট।
এ ছাড়া এই কনভেনশানের আরো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তার মধ্যে ১ (২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট বলছে : এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন অজুহাত চলবে না। বলা যাবে না যে ‘গুম’ ঘটছে বিশেষ কোন পরিস্থিতির জন্য। যেমনÑ যুদ্ধ, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা অন্য যে কোন ধরনের জরুরি অবস্থা। কোন প্রকার বিশেষ অবস্থা ‘গুম’ করার পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য অজুহাত হিশাবে গৃহীত হবে না। এরপর অনুচ্ছেদ পাঁচে রয়েছে যে, যদি ‘গুম’ হওয়া বেড়ে যায় কিম্বা ‘গুম’ করে ফেলা রাষ্ট্রের নিয়মিত চর্চা হয়ে ওঠে তাহলে আন্তর্জাতিক আইনে যেভাবে ব্যাখ্যা করা আছে সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী তা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিশাবে গণ্য হবে। ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ আন্তর্জাতিক আইনে অতিশয় নিন্দিত ও ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ। এর জন্য যে পরিণতি ঘটবার বা শাস্তি হবার কথা সেই শাস্তি থেকে নিস্তার পাবার সুযোগ নাই।
প্রথম আলো একটি উপসম্পাদকীয়তে মিজানুর রহমান খান লিখেছেন যে, “আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক) এবং ‘অধিকার’ আমাদের দুটি শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন। তারা গুমের বিষয়ে কাজ করছে। কিন্তু আন্তরিকতা সত্ত্বেও তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো একটি গুমকেও ‘প্রমাণিত ঘটনা’ হিসেবে দাবি করতে পারেনি। তারা সব কিছু করে শেষে বলে ‘সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ পাওয়া গেছে। ‘প্রমাণ পাওয়া গেছে’Ñ তারা একটুও বলতে পারে না” (দেখুন, “ইলিয়াসের ‘গুমের’ বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে”, ২২ এপ্রিল ২০১২)।

এই মন্তব্য একজন মানবাধিকার কর্মী হিশাবে আমার কাছে বিপজ্জনক মনে হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘আনুষ্ঠানিক ভাবে’ একটি গুমকেও ‘প্রমাণিত ঘটনা’ হিশাবে দাবি করতে পারে নি বলার অর্থ কী? তার মানে বাংলাদেশে কোনো গুমের ঘটনা ঘটেনি? মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিচার বিভাগ নয়, ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে প্রমাণ করবার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। গুমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ‘সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ প্রমাণ করাই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দায়িত্ব। সেই অভিযোগ সত্য কি না এবং এর জন্য রাষ্ট্রের কোন বিভাগ বা কোন কর্তৃপক্ষ দায়ী সেটা তদন্ত করবার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের, বিচার করবার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। সর্বোপরি ‘গুম’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশান আত্মস্থ করে আইন প্রণয়ন করবার দায়িত্ব জাতীয় সংসদের। আর যদি তারা ব্যর্থ হয় তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে তার দায় সকলের। বাংলাদেশের বিচার বিভাগকেও সেই দায় নিতে হবে। তখন এই ‘সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ আন্তর্জাতিক নজরদারি ও বিচারের অধীন হতে পারে। গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশানে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের মৌনতা রাষ্ট্রকে দায় থেকে খালাস করে না।
‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ তাঁদের কথা বলবেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর উপদেষ্টা হিশাবে বলে রাখা দরকারÑ আমরা ২০০৯ সালে দুই জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, এবং ২০১১ সালে সালে ৩০ জন ব্যক্তি গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘গুম’ হবার কথা বলেছি। এই বছর ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ জন ব্যক্তি ‘গুম’ হয়েছেন। তার মানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের কোনো-না-কোনো এজেন্ট এই গুম হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
অনেকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘গুম’ হবার সংখ্যার হিশাবে মেলে না বলে বিভ্রান্ত হন। সেই দিক থেকে অধিকারের সংখ্যা কম হবার কারণ হচ্ছে, কেউ নিখোঁজ হলেই তাকে ‘গুম’ বলে সংজ্ঞায়িত করা ভুল। এটা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। এটা সংখ্যা দিয়ে সরকার বা রাষ্ট্রকে বিব্রত বা বিপদে ফেলবার ব্যাপার নয়, এটা সংজ্ঞার মামলা। রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত হয় এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ’ উঠতে পারে।
এই বিপদের কথা মনে রেখেই ‘অধিকার’ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ যেন গুম হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুমোদন দেয় তার জন্য প্রচার চালিয়ে আসছে। এই প্রচারের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই দিকে নজর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনার পর সেটা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

আজ দৈনিক সমকালে দেখছি কেবল দশ শর্ত মানলেই ইলিয়াস ‘মুক্তি’ পেতে পারেন। এই শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে একই সঙ্গে ইলিয়াস ও বিএনপিকে। এর মধ্যে পাঁচটি শর্ত মানতে কিছুটা সম্মত হলেও বাকি শর্তগুলো কঠিন হওয়ায় বিএনপির হাই কমান্ড মানতে রাজি না। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, মুক্তি পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে নিজ থেকে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন ইলিয়াসকে এই কথা বলতে হবে। বলতে হবে, বিদায়ী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের ঘটনায় তার ড্রাইভারের প্ররোচনা ছিল। তিনি রাজনীতি করবেন না এমন প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে। এই সব। দেখুন, ‘১০ শর্ত মানলে মুক্তি ইলিয়াস আলীর’ (দৈনিক সমকাল, ২৩ এপ্রিল, ২০১২)। 
দৈনিক সমকালের এই খবর সঠিক নাকি প্রপাগান্ডা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। এই খবরের মূল সুর দুইটা : এক. ইলিয়াস ‘গুম’ হয়ে সরকারের কাছেই আছেন; দুই. বিএনপি এটা জানে এবং তাকে মুক্ত করবার জন্য ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের দেনদরবার চলছে। সমকালের এই প্রতিবেদন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ওপর ভিত্তি করে কোন মন্তব্য এখন অনুচিত। তবে এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে। এই ধরণের খবরের বিপজ্জনক দিক হচ্ছে ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরোধ হিশাবে হাজির করা। তার সমাধানও যেন দুই পক্ষের দেনদরবারের মধ্যেই নিহিত। ফলে ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভীষিকা ও তার তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের সম্পর্ক অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা ঘটে। ইলিয়াস যেন জীবিত ফিরে আসেন, এটাই এখনকার প্রধান প্রত্যাশা হওয়া উচিত। পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে তিনি ফিরে এলে বা না এলে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ‘গুম’ হওয়ার শিকার বলেই গণ্য হবেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি ‘গুম’ হওয়ার পরেও বেঁচে ফিরে এসেছেন বলে বিবেচনা করা হবে। রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে ‘গুম’ করেছে এই অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। একই সঙ্গে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। ক্ষমতাসীনদের জন্য ইলিয়াস আলী এখন শাঁখের করাত হয়ে গিয়েছেন। 
যদি সমকালের খবর সত্য হয় তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ক্ষমতাসীনরা চাইছে তিনি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছেনÑ এই কথা স্বীকার করিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক নিন্দা ও চাপের হাত থেকে আপাতত রেহাই পাওয়া। পরিস্থিতি যেখানে গিয়েছে তাতে এই দায় থেকে সরকারের নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন হবে। 
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব আসলে কাদের? কাদের কাছে তারা তাদের কাজের জবাবদিহি করে বা করতে বাধ্য। যদি ক্ষমতাসীনদের নির্দেশেই ‘গুম’ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে বাংলাদেশে জবাবদিহিতার সুযোগ নাই বললেই চলে। বিচার বিভাগের ভূমিকা থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিচার বিভাগও ক্ষমতাসীনদের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট ‘গুম’ করছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে একই ধরণের ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা নাই। তার মানে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গোড়ার প্রশ্ন উহ্য রেখে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে সাধারণ ভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের সঙ্গে রাষ্ট্র ও রজানীতির সম্পর্ক কোথায়। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির মানবিক ও নাগরিক অধিকারকে নিজের গাঠনিক ভিত্তি হিশাবে স্থাপন না করে, যদি ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য তার অন্তর্নিহিত চরিত্র বানিয়ে গড়ে না ওঠে তাহলে এই রাষ্ট্র ভেঙে নতুন করে বাংলাদেশ গড়া ছাড়া জনগণের সামনে আর কোন পথই খোলা নাই। এই ক্ষেত্রে মানবাধিকার-বিরোধী একটি ফ্যাসিস্ট দলের বিপরীতে মানবাধিকার-বিরোধী আরেকটি একনায়কতান্ত্রিক ও গণবিরোধী দলের পক্ষে দাঁড়াবার কোনই যুক্তি নাই। যে রাজনৈতিক দলগুলো মানবিক ও নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করে না, যারা জাতীয় সংসদে গিয়ে ১৪২ অনুচ্ছেদের শক্তি ব্যবহার করে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, সেই দলগুলোর কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? দেশে-বিদেশে খুনি বাহিনী হিশাবে খ্যাত র‌্যাব গঠন করেছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, নির্বাচনী বক্তৃতায় র‌্যাবের কর্মকাণ্ডের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগ সেই র‌্যাবকেই ব্যবহার করেছে। আজ অনেকে র‌্যাব ভেঙে দেবার কথা বলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যখন ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিল, তখন অবশ্য অনেককেই দোনমোনা করতে দেখেছেন। কথা হচ্ছে শুধু র‌্যাব ভেঙে দিলে হবে না, আরো বহু গোড়ার জিনিস ভেঙে নতুন ভাবে বাংলাদেশ গড়তে হবে। গড়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই।

অনেকে ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে হরতালে আপত্তি জানাচ্ছেন। তাঁদের যুক্তি, এতে মানুষের অসুবিধা হয়, ব্যবসাবাণিজ্যে বাধা তৈরি হয়, দেশের অর্থনীতি বিপদে পড়ে, হরতালের সময় গাড়ি ভাঙচুর হয়, নাগরিকদের সম্পদের ক্ষতি হয়, ইত্যাদি। হরতাল সফল করবার জন্য হরতালের আগের দিন ভয়ভীতি সঞ্চারের কর্মসূচি নেওয়া হয়। এতে জ্বালাও পোড়াও করতে গিয়ে নিরীহ নাগরিকদের পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে। এবারও গাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা গাড়ির চালক বদর আলী বেগ পুড়ে মরেছেন, তার সহকারী মোতালেব অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। গ্রামে বদর আলীর গরিব স্ত্রী, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনদের আহাজারি দেখেছি। কিছু দিন পর এদের নাম কারো মনে থাকে না। এরা হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে হত্যার চিহ্নগুলো বড় সহজেই মুছে যায়। এই সকল কারণে হরতালের বিরুদ্ধে নাগরিকদের ুব্ধ হবার বিস্তর কারণ আছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসুবিধা ছাড়াও মানবিক সংবেদনাও এখানে কাজ করে, যে সংবেদনা ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না। এই সকল যুক্তি অস্বীকার করবার কোন কারণ নাই। এমনকি এমন একটি ‘গুম’ ঘটে যাবার পরেও মানবাধিকার কমিশনের চেয়াম্যানও হরতালে আপত্তি জানিয়েছেন। বিশেষত, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তাদের কথা ভেবে তিনি হরতাল না করার মিনতি জানিয়েছেন। যদিও মানবাধিকারের দিক থেকে একজন নাগরিকের ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ভয়ানক দুঃসংবাদ। রাষ্ট্রের জন্য এটা খুবই বড় ধরনের সঙ্কট।
প্রহসন হোল হরতালের বিপক্ষে একই যুক্তি ক্ষমতাসীনরাও দিয়ে থাকে। গাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা একজন নিরীহ ড্রাইভার পুড়ে মরার পরপরই আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে প্রতিপক্ষকে দায়ী করলেন তাতে বোঝা মুশকিল আসলে এই হত্যার জন্য কোন পক্ষ দায়ী। টেলিভিশনে বদর আলীর একজন আত্মীয়কে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুনেছিÑ দুই দলই এর জন্য দায়ী। তাদের রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষ। গণবিরোধী এই দুই পক্ষের বিরুদ্ধে গ্রামের একজন সাধারণ মহিলার সচেতনতা অর্থপূর্ণ মনে হোল। যত বেশি জনগণ অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী ও মানবিক অধিকারবিরোধী শক্তি ও শ্রেণীর বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠবেন ততই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ ও পদ্ধতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
হরতালের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মুখে যে যুক্তি আমরা শুনি সেটা এর আগে বিএনপি ও চারদলীয় জোটের কাছেও আমরা শুনেছি। সেই গীত এখন শুনছি আওয়ামী লীগ ও তাদের মহাজোটের মহান সব সদস্যের মুখেও। ফলে নাগরিকদের ন্যায্য ক্ষোভ প্রকারান্তরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই কাজ করে। এটাই প্রহসন। বিএনপি অফিস বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব যেভাবে ঘিরে রাখে এবং বিরোধী দলের মিছিলে ও সভায় যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা করে তা অবিশ্বাস্য, কিন্তু এই কাজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়েও হয়েছে। তার মানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দলীয় স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। তাদের ব্যবহার করা যায়। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দল তাদের ব্যবহার করে নির্দয়ভাবে বিরোধী প্রতিপক্ষকে দমন করবার জন্য। যে দল ক্ষমতায় যায় সেই দলের সন্ত্রাসী বাহিনী হিশাবে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহৃত হয়। নাগরিকদের সাংবিধানিক বা আইনি অধিকারের কোন তোয়াক্কা তারা করে না। কারণ ক্ষমতাসীনরা তাদের দায়মুক্তির দায় নিজেরাই তাদের কাঁধে নিয়ে নেয়, নিজেরাই বহন করে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক যে পরিস্থিতি তাতে নাগরিকদের লাগাতার আন্দোলন সংগ্রামে নেমে পড়বার কথা। এই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান চায় সকলেই, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে বিএনপি ও তার অধীনস্থ জোটের সদস্যদের দলীয় সমর্থকরা ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেনা। অন্তত যেভাবে নামা উচিত সেভাবে নামছে না। এর কারণ বিএনপি জনগণকে কোন রাজনীতি দিতে পারছে না। আদৌ পারবে কি না সন্দেহ। স্রেফ আওয়ামী বিরোধিতা ও নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সকারের দাবি কোন রাজনীতি হতে পারে না। এই রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি রেখে বিএনপি ক্ষমতা চায়। ক্ষমতার হাতবদল চায়, কিন্তু রাষ্ট্রের কোন রূপান্তর চায় না। যে কারণে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংকটের চেয়েও সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন মানুষের কাছে বারবার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও মানুষ তার বিরোধিতা করে। জানে, এর ফলে তাকে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির স্বীকার হতে হবে তার পরিবর্তে রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইতিবাচক কোন রূপান্তর ঘটবে না। কারণ সেটা ঘটাবার কোন দৃশ্যমান রাজনৈতিক কর্মসূচি মানুষের সামনে হাজির নাই। গুম ভীতিকর অবশ্যই। শুধু গুম নয়, ভবিষ্যৎ কর্মসূচির অনুপস্থিতিই বরং সবচেয়ে বেশি ভীতিকর। মানবিক অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাক্সা এবং তার পক্ষে রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের বিপরীতে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ মুখ্য হয়ে যাবার এই প্রবণতাই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক।
২৩ এপ্রিল ২০১২। ১০ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন