শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২


ফেব্রুয়ারির পিলখানা : ভাষার মাস আর আগের মতো নাই

২০১২-০২-২৫

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আবেগ, ভালবাসা ও রাজনীতির মাস। কিন' আমার অনুমান ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ২৫-২৬ তারিখে পিলখানায় যে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছিল, তার পর থেকে ফেব্রুয়ারি ঠিক আগের মতো আর নাই। এর মানে এই নয় যে ভাষা, সাহিত্য বা সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আবেগ উবে যাবে কিম্বা ভাষা ও সংস্কৃতি যেভাবে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় পরিগঠনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে সেই সব মুছে যাবে। এমনকি আগামি দিনে তার রূপ কী দাঁড়াতে পারে সেই সকল বিষয় নিয়ে বিবেচনার অবসরও আমাদের কমে যাবে। না, তা হবে না। সেটা বলছি না।

তাহলে ফেব্রুয়ারি আগের মতো আর নাই বলছি কোন অর্থে? এক দিক থেকে উত্তর দেওয়া সহজ। দুই হাজার নয় সালের ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ পিলখানায় একটি রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল। এই হত্যাযজ্ঞের কুফল বাংলাদেশের ওপর একটা কালো ছায়া ফেলেছে। এই অন্ধকার দীর্ঘস'ায়ী হতে বাধ্য। এটা হচ্ছে সহজ উত্তর। হতে পারে যে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ২৫ ও ২৬ তারিখকে আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাব, বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের দিক একটি বিচ্ছিন্ন ও গৌণ ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করব। তবে ২০১২ সালে এই দুটো দিন বিভিন্ন গণমাধ্যম কিভাবে হাজির করে তার মধ্য দিয়ে আমাদের স্মৃতিশক্তির মাত্রা সম্পর্কে খানিক আন্দাজ করতে সক্ষম হবো আমরা। দেখা যাক। 

কিন' যে অর্থে ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই বলছি তাকে এই ধরনের সহজ উত্তরের মধ্যে বোঝা যাবে না। যে অন্ধকার ছায়ার কথা বলছি সেটাও সম্ভবত ততোটা বিপদের নয়, যদি অন্ধকার থেকে সদর রাস-ায় উঠবার রাস-া সম্পর্কে আমাদের হুঁশ থাকত। মুশকিল হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাবার রাস-া আমাদের জানা নাই। সেটা পরিষ্কার ধরা পড়েছে বিডিআরের সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ থেকে আলাদা করে দেখা ও বিচার করবার ব্যর্থতা থেকে। অর্থাৎ ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে দুটো ঘটনা ঘটেছে। সেটা সমান-রালে ঘটেছে, নাকি বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারদের নির্যাতন ও হত্যার পরিকল্পনা আলাদা ভাবে করা হয়েছে, আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না। তবে অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। ক্ষমতাসীন সরকারও তার দায়দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলা যাবে না। আসলে কী ঘটেছিল, কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল, অন্য কোন দেশ এর সঙ্গে জড়িত ছিল কি না- এই সকল নানান প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। এই জায়গাগুলোতে অন্ধকার এমনই জমাট বেঁধেছে যে সেখানে আলো প্রবেশ করবার সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বিদ্রোহ যে আলাদা সেটা হয়তো আমরা অনেকে আন্দাজ করেছি, কিন' আলাদা করে দেখা বা বিচার করার প্রয়োজনীয়তা বুঝি নি। যদি বুঝতাম তাহলে সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহের সুস্পষ্ট কারণগুলোকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতাম। সেই কারণগুলোর দিকে নজর রাখলে এই উপলব্ধিও কঠিন হোত না যে এই ধরণের কারণ সেনাবাহিনীর মধ্যে জিইয়ে রাখা ব্রিজের নিচে ডিনামাইট ফিট করে রাখবার মতো আহাম্মকি। পুরা ব্রিজই যেকোন সময় উড়ে যেতে পারে। তাহলে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই আমরা বুঝতাম বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটা আমূল সংস্কারের দরকার আছে। এই কাণ্ডজ্ঞান যদি আমাদের থাকত তাহলে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা এবং সাধারণ সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার পথ সম্পর্কে সমাজে খোলামেলাই আলোচনা করতাম আমরা। এটা শুধু সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা নয়। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। কিন' সেটা আমরা করি নি। ডিনামাইট পাতাই রয়েছে। অতএব আমরা শুধু অন্ধকার জমিয়ে রাখিনি, সেই অন্ধকার সময়ে অসময়ে বিস্ফোরণের ব্যবস'াও পাকা করে রেখেছি। 

এই ঘটনার জন্য দায়ী বিডিআরদের বিচার করবার সময় আমরা চরম ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। হেফাজতে থাকা অবস'ায় নির্যাতনে অভিযুক্ত অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে সচেতন থেকে সাধারণ সৈনিকদের সুবিচারের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। এতে সেনা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে দূরত্ব কমে নি, বরং বেড়েছে। অন্য দিকে বিডিআরের নাম ও পোশাক পরিবর্তন করে পুরা বাহিনীকে হীনমর্যাদায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নামের মধ্য দিয়ে যাদের আমরা সীমানে- সশস্ত্র প্রতিরক্ষা বাহিনী বলে গণ্য করতাম তারা এখন হয়েছে সীমানে-র দারোয়ান মাত্র- বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড। তারা ‘ডিফেন্স রাইফেলস’ নয়, ‘বর্ডার গার্ড’। বাংলাদেশকে পরিকল্পিত ভাবে অরক্ষিত রাখবার পরিকল্পনাই সচেতন ভাবে বাস-বায়ন করা হয়েছে। এরপর সীমানে-র কাঁটাতারে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর গুলি খেয়ে ফালানীর লাশ আমরা ঝুলতে দেখেছি। দেখেছি কিভাবে ল্যাংটা করে বাংলাদেশীদের পেটানো হয়। শুনেছি, কিভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর তরফে বলা হচ্ছে সীমানে- গুলি চালানো বন্ধ হবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান- পৃথিবীর যেকোন সীমানে-র চেয়েও এখন রক্তাক্ত, লাশে ছিন্নভিন্ন। 

কিন' ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই তার উত্তরও এই সকল ব্যর্থতা ও ভয়াবহ অধঃপতনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে বিডিআরের ঘটনার সূত্র ধরে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তার ফলে বাস-ব পরিসি'তির কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রশ্ন তোলা ও বিচার করার মধ্যে একটা গুণগত রূপান-র ঘটছে, এই অর্থেই বলছি ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই। বিডিআরের ঘটনার পরিণতি হিশাবে বাংলাদেশ নিজেকে রাষ্ট্র হিশাবে রক্ষা করবার ও বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস'ায় টিকে থাকবার ক্ষমতা হারিয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়েছে। সেনাবাহিনী নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নির্যাতকের ভূমিকা হয়তো এখনো পালন করতে সক্ষম, এবং তা করতে গিয়ে সৈনিকতার মর্যাদা ধুলায় মিলিয়ে দিতেও হয়তো অনেকের দ্বিধা হবে না। কিন' এখন সেনাবাহিনী তার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি যেমন হারিয়েছে, তেমনি তার নৈতিক বলেরও ক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ, তার শক্তিও কম। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে নিজেকে রক্ষা করবার হিম্মত বাংলাদেশের কখনই হয়তো ছিল না। কিন' যে ন্যূনতম শক্তি ছাড়া একটি রাষ্ট্র নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে না, সেই শক্তিও বাংলাদেশ এখন হারিয়েছে। বাংলাদেশ এখন সব অর্থেই অরক্ষিত। এই কাজ পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে কি না সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন' যা ঘটে গিয়েছে সেই পরিসি'তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এখন আর সহজ নয়। বিশেষত সীমানে- কাঁটাতার ও নিরন-র কুকুরবিড়ালের মতো বাংলাদেশের মানুষ হত্যা, ফালানীর লাশ ঝুলে থাকা, পানির হিস্যা না পাওয়া, ভারতকে একতরফা করিডোর দিয়ে দেওয়া- ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি তা কিছুটা টের পাচ্ছি। তার পরেও দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মৈত্রী’র স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অনেকে আমাদের। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। 

তাহলে কী দাঁড়াল? ফেব্রুয়ারি আগে ছিল ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ চর্চার মাস। এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে অভিন্ন সম্পর্ক সমাজে এত দিন অনুমান করা হয়েছে সেখানে অনেক দিন থেকেই সঙ্গত কারণে চিড় ধরেছে। মুশকিল হচ্ছে এই জাতীয়তাবাদ আমাদের একটি অখ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে না, বরং ভয়াবহ বিভাজন ও বিরোধ সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিকতার পরিগঠনের দিক থেকে এই বিপদগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। আমরা টের পাচ্ছি তথাকথিত ‘জাতি’ সত্তা বা নানান কিসিমের জাতীয়তাবাদের কেচ্ছা ও কল্পনার ভূত থেকে মুক্ত হয়ে একটি অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের পরিগঠন করতে হলে আমাদের শত্রু-মিত্র নির্ধারণের মানদণ্ড বদলাতে হবে। হয়তো প্রথাগত জাতীয়তাবাদী ধারণা এই নতুন বাস-বতা মোকাবেলায় আমাদের আর কাজে লাগবে না। আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই কর্তব্য উপলব্ধি করবার সামর্থ্য আদৌ আমাদের আছে কি না সেটা পরীক্ষার একটা চমৎকার সময় হাজির হয়েছে। ঠিক। এই অর্থেও ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই। 

আত্মপরিচয়ের বিড়ম্বনার বিচারে মোটা দাগে দুই ধরনের জাতীয়তাবাদী ভূতে আমরা আক্রান-। এক হচ্ছে মুসলমানি ভূত। মুসলমানরাই এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অতএব মুসলমানিত্বই এই দেশের মানুষের একমাত্র পরিচয় হতে হবে। এই দাবি করতে গিয়ে ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির জটিল সম্পর্ক ও টানাপড়েন অন্যায় ভাবে অস্বীকার করা হয়। ইসলাম আরব দেশের ধর্ম। এর সঙ্গে আরবি ও আরব সংস্কৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ক। কিন' ইসলাম যখন এই দেশে এসেছে তখন তাকে এই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বিকাশের সুবিধা খুঁজতে হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল বিকাশ ঘটিয়েছে। ইসলাম কায়েমের মানে নিশ্চয়ই স'ানীয় ভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষা, কিম্বা স'ানীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে আরব সংস্কৃতি আমল করার মধ্যে পর্যবসিত করা নয়। যদি মুসলমানিত্বই আমাদের পরিচয় হয়ে ওঠে তখন সেখানে একটা অনাবশ্যক ও অস্বাভাবিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে এই উপমহাদেশে ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে শুধু নয়, জাতপাত শ্রেণীর পার্থক্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে তাকেও নাকচ করে দেওয়া হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এই উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস থেকে অভিন্ন নয়। এই আত্মপরিচয়ের ভূত একাত্তর সালে আমাদের কাঁধ থেকে নেমে যাবার কথা ছিল। পাকিস-ান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রাম এই ভূতকে কাঁধ থেকে নেমে যেতে বাধ্য করেছিল। তখন ইসলামের সঙ্গে আমাদের একটি ঐতিহাসিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হবার বিপুল সুযোগ তৈরি হয়। কিন' আমরা তা হেলায় হারিয়েছি। তাকে কাজে লাগাই নি।

কিন' ইতোমধ্যে আমাদের কাঁধে দ্বিতীয় ভূত চাপে। এই ভূত দাবি করতে থাকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়া আমাদের আর কোন পরিচয় নাই। ইসলাম তো নয়ই। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামকে শত্রু হিশাবে হাজির করতে থাকে। আগের ভূতের মতো এরাও উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকা বিশেষত জাতপাত-বিরোধী লড়াই এমনকি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামের ভূমিকাকে অস্বীকার করে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাদের অবস'ান হয় মূলত ইসলামের বিরোধিতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিজেদের গড়ে ওঠার ইতিহাসের দিকে আরো বিস-ৃত, ব্যাপক ও গভীর ভাবে তাকাবার সুযোগ করে দিয়েছিল, কিন' এই ভূত আমাদের আরো অন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি হোল, বাস-ব ইতিহাস নয়, একমাত্র ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের পরিচয়ের একমাত্র ভিত্তি। এক প্রকার ‘আবহমান বাংলা ও বাঙালির’ কল্পনা করা হয়, যাদের সঙ্গে কখনো ইসলামের মোলাকাত হয়েছে বলে প্রমাণ নাই। সকল নজির গরহাজির হয়ে যায়। ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতার বিপরীতে তৈরি হয় আরেক উগ্র ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক সামপ্রদায়িকতা। আমরা বাঙালি- এর অর্থ আদতে গিয়ে দাঁড়ায় ইসলাম-বিরোধী হওয়ার বীরত্বে, বাঙালির জীবনযাপন ও ইতিহাস থেকে ইসলামকে জবরদসি- বাদ দেওয়ার অস্বাভাবিকতায়। এমনকি ইতিহাস সম্পর্কে যাঁদের কাছ থেকে সচেতনতা আশা করা গিয়েছিল তাঁরাও অনায়াসে লিখলেন মুসলমানরা ঘরে ফিরে এসেছে, তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। যার প্রচ্ছন্ন অর্থ দাঁড়ায় এই জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে ধর্মান-রিত হয়ে ভুল করেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। নিজ দেশ সে ত্যাগ করে গিয়েছিল, এখন আবার প্রত্যাবর্তন করেছে। ইত্যাদি। 
আগের ভূত দেখল এতো ভারি সুবিধা। ইতিহাসের এই ফাঁকির জায়গায় যে ভূত আমাদের কাঁধ থেকে নেমে গিয়েছিল বলে একাত্তরে আমরা ভেবেছিলাম সেই ভূত আরো শক্তি নিয়ে আবার আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল। তারা সহজেই দাবি করতে পারল ‘বাঙালি’ হওয়ার কথা বলে আমাদের আসলে ‘হিন্দু’ বানানো হচ্ছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের চর্চার নজির দেখিয়ে এই প্রচারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা কঠিন ছিল না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কল্যাণে আমাদের কাঁধে এখন একটা নয়, দুই দুইটা ভূত এক সঙ্গে সওয়ার করেছে। মারহাবা। আমাদের হানাহানি রক্তপাত রাজনৈতিক বিভাজন ও অসি'তিশীলতার গোড়ায় রয়েছে এই দুই ভূতের কোন্দল। এই কোন্দল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাংলাদেশ আদৌ রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকতে পারে কি না সেটাই সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। 

যদি আমরা বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে দুই ধরণের ভূতের কারবার ছাড়তে হবে। এক হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র বিভাজন আর অন্য দিকে ধর্মের জায়গায় দাঁড়িয়ে শত্রু-মিত্র নির্ণয় করবার কারবার। অর্থাৎ এই দুই ধরণের সামপ্রদায়িকতা আমাদের শত্রু। এই দোষ ত্যাগ করলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ও আরবসভ্যতার সম্পর্ক নিজের গতিতেই এগুবে। রাজনৈতিকতার পরিমণ্ডলে কিম্বা রাষ্ট্র গঠনের পরিমণ্ডলে বারবার বিপদ ডেকে আনবে না। 

আমাদের উপলব্ধি করতে হবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে বাংলাদেশকে দুই ভাগে ভাগ করলে আমরা টিকে থাকতে পারব না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই বিভাজনের মীমাংসার জন্য যে ইতিহাস চেতনার দরকার আমরা তা অর্জন করি নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের দিক থেকে যদি দেখি তাহলে আমাদের সমস্যা আসলে মুসলমান বনাম বাঙালি হবার দ্বন্দ্ব নয়, বরং এই উপমহাদেশে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকবার সমস্যা। শুধু তা-ই নয়, এই উপমহাদেশে সকল নির্যাতিত জাতি, বর্ণ, শ্রেণীর পক্ষে লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করার মধ্য দিয়েই আমাদের বিকাশ ঘটবে। এই লড়াইয়ের জায়গায় দাঁড়িয়েই ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন করে বিচার ও বিবেচনা করতে আমাদের শিখতে হবে। 

আমার ধারণা, নিজেদের সংকট উপলব্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের জনগণ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। কিন' রাষ্ট্র গঠনের অন্যান্য প্রশ্ন মীমাংসার আগে বাংলাদেশের সামনে প্রধান বিপদ হিশাবে হাজির হয়েছে ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী বা সংক্ষেপে দিল্লি। দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কূটনৈতিক ভাবে মোকাবিলার সুযোগ নাই বললেই চলে। শুধু পানি নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধ আরো তীব্র হতে বাধ্য, যা মূলত পুরা উপমহাদেশকেই অসি'তিশীল করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান- পরিসি'তি এতোই নাজুক হয়ে উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিজেরাই উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে এখন। এই দিক থেকেও দুই হাজার নয় সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এবং তার পরিণতিতে সীমান-রক্ষী বাহিনী হিশাবে বিডিআরের পরিবর্তনকে বাংলাদেশের জনগণ সহজ ভাবে মেনে নিচ্ছে না। এর অভিপ্রকাশ কিভাবে ঘটবে এখনো তা পরিষ্কার নয়। রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রশ্ন যদি আসে তাহলে সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন' প্রথাগত সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশ রক্ষা অসম্ভব। বাংলাদেশকে অবশ্যই গণপ্রতিরক্ষার পথে অগ্রসর হতে হবে। এর সহজ মানে হচ্ছে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীকে নিলে চলবে না, এই দায়িত্ব সকল নাগরিককের। গণশক্তির লালন ও বিকাশ ছাড়া বিচ্ছিন্ন সামরিক শক্তি দিয়ে দিল্লির সঙ্গে মোকাবিলা সম্ভব নয়, বাস-ব পরিসি'তি এই সত্য উপলব্ধির জন্য এখন অনেক সহায়ক হয়ে উঠেছে। 

ফেব্রুয়ারি ভাষা ও সংস্কৃতির রাজনীতিকরণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে এতকাল ভাষা ও সংস্কৃতির মানদণ্ড দিয়ে বুঝতে চেয়েছে। আমার অনুমান, এই পর্যায় আমরা দ্রুত অতিক্রম করছি। দুই হাজার নয় সালের ২৫-২৬ তারিখের ঘটনাবলি ও তার পরিণতি বিচার করলে ফেব্রুয়ারি আমাদের গণপ্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভাববার জন্য তাগিদ দিয়ে যেতে থাকবে। 
ঠিক। ফেব্রুয়ারি আর আগের জায়গায় নাই। 
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২। ১২ ফাল্গুন ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন