শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২


ফেব্রুয়ারির পিলখানা : ভাষার মাস আর আগের মতো নাই

২০১২-০২-২৫

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আবেগ, ভালবাসা ও রাজনীতির মাস। কিন' আমার অনুমান ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ২৫-২৬ তারিখে পিলখানায় যে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছিল, তার পর থেকে ফেব্রুয়ারি ঠিক আগের মতো আর নাই। এর মানে এই নয় যে ভাষা, সাহিত্য বা সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আবেগ উবে যাবে কিম্বা ভাষা ও সংস্কৃতি যেভাবে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় পরিগঠনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে সেই সব মুছে যাবে। এমনকি আগামি দিনে তার রূপ কী দাঁড়াতে পারে সেই সকল বিষয় নিয়ে বিবেচনার অবসরও আমাদের কমে যাবে। না, তা হবে না। সেটা বলছি না।

তাহলে ফেব্রুয়ারি আগের মতো আর নাই বলছি কোন অর্থে? এক দিক থেকে উত্তর দেওয়া সহজ। দুই হাজার নয় সালের ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ পিলখানায় একটি রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল। এই হত্যাযজ্ঞের কুফল বাংলাদেশের ওপর একটা কালো ছায়া ফেলেছে। এই অন্ধকার দীর্ঘস'ায়ী হতে বাধ্য। এটা হচ্ছে সহজ উত্তর। হতে পারে যে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ২৫ ও ২৬ তারিখকে আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাব, বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের দিক একটি বিচ্ছিন্ন ও গৌণ ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করব। তবে ২০১২ সালে এই দুটো দিন বিভিন্ন গণমাধ্যম কিভাবে হাজির করে তার মধ্য দিয়ে আমাদের স্মৃতিশক্তির মাত্রা সম্পর্কে খানিক আন্দাজ করতে সক্ষম হবো আমরা। দেখা যাক। 

কিন' যে অর্থে ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই বলছি তাকে এই ধরনের সহজ উত্তরের মধ্যে বোঝা যাবে না। যে অন্ধকার ছায়ার কথা বলছি সেটাও সম্ভবত ততোটা বিপদের নয়, যদি অন্ধকার থেকে সদর রাস-ায় উঠবার রাস-া সম্পর্কে আমাদের হুঁশ থাকত। মুশকিল হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাবার রাস-া আমাদের জানা নাই। সেটা পরিষ্কার ধরা পড়েছে বিডিআরের সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ থেকে আলাদা করে দেখা ও বিচার করবার ব্যর্থতা থেকে। অর্থাৎ ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে দুটো ঘটনা ঘটেছে। সেটা সমান-রালে ঘটেছে, নাকি বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারদের নির্যাতন ও হত্যার পরিকল্পনা আলাদা ভাবে করা হয়েছে, আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না। তবে অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। ক্ষমতাসীন সরকারও তার দায়দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলা যাবে না। আসলে কী ঘটেছিল, কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল, অন্য কোন দেশ এর সঙ্গে জড়িত ছিল কি না- এই সকল নানান প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। এই জায়গাগুলোতে অন্ধকার এমনই জমাট বেঁধেছে যে সেখানে আলো প্রবেশ করবার সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বিদ্রোহ যে আলাদা সেটা হয়তো আমরা অনেকে আন্দাজ করেছি, কিন' আলাদা করে দেখা বা বিচার করার প্রয়োজনীয়তা বুঝি নি। যদি বুঝতাম তাহলে সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহের সুস্পষ্ট কারণগুলোকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতাম। সেই কারণগুলোর দিকে নজর রাখলে এই উপলব্ধিও কঠিন হোত না যে এই ধরণের কারণ সেনাবাহিনীর মধ্যে জিইয়ে রাখা ব্রিজের নিচে ডিনামাইট ফিট করে রাখবার মতো আহাম্মকি। পুরা ব্রিজই যেকোন সময় উড়ে যেতে পারে। তাহলে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই আমরা বুঝতাম বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটা আমূল সংস্কারের দরকার আছে। এই কাণ্ডজ্ঞান যদি আমাদের থাকত তাহলে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা এবং সাধারণ সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার পথ সম্পর্কে সমাজে খোলামেলাই আলোচনা করতাম আমরা। এটা শুধু সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা নয়। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। কিন' সেটা আমরা করি নি। ডিনামাইট পাতাই রয়েছে। অতএব আমরা শুধু অন্ধকার জমিয়ে রাখিনি, সেই অন্ধকার সময়ে অসময়ে বিস্ফোরণের ব্যবস'াও পাকা করে রেখেছি। 

এই ঘটনার জন্য দায়ী বিডিআরদের বিচার করবার সময় আমরা চরম ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। হেফাজতে থাকা অবস'ায় নির্যাতনে অভিযুক্ত অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে সচেতন থেকে সাধারণ সৈনিকদের সুবিচারের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। এতে সেনা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে দূরত্ব কমে নি, বরং বেড়েছে। অন্য দিকে বিডিআরের নাম ও পোশাক পরিবর্তন করে পুরা বাহিনীকে হীনমর্যাদায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নামের মধ্য দিয়ে যাদের আমরা সীমানে- সশস্ত্র প্রতিরক্ষা বাহিনী বলে গণ্য করতাম তারা এখন হয়েছে সীমানে-র দারোয়ান মাত্র- বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড। তারা ‘ডিফেন্স রাইফেলস’ নয়, ‘বর্ডার গার্ড’। বাংলাদেশকে পরিকল্পিত ভাবে অরক্ষিত রাখবার পরিকল্পনাই সচেতন ভাবে বাস-বায়ন করা হয়েছে। এরপর সীমানে-র কাঁটাতারে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর গুলি খেয়ে ফালানীর লাশ আমরা ঝুলতে দেখেছি। দেখেছি কিভাবে ল্যাংটা করে বাংলাদেশীদের পেটানো হয়। শুনেছি, কিভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর তরফে বলা হচ্ছে সীমানে- গুলি চালানো বন্ধ হবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান- পৃথিবীর যেকোন সীমানে-র চেয়েও এখন রক্তাক্ত, লাশে ছিন্নভিন্ন। 

কিন' ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই তার উত্তরও এই সকল ব্যর্থতা ও ভয়াবহ অধঃপতনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে বিডিআরের ঘটনার সূত্র ধরে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তার ফলে বাস-ব পরিসি'তির কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রশ্ন তোলা ও বিচার করার মধ্যে একটা গুণগত রূপান-র ঘটছে, এই অর্থেই বলছি ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই। বিডিআরের ঘটনার পরিণতি হিশাবে বাংলাদেশ নিজেকে রাষ্ট্র হিশাবে রক্ষা করবার ও বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস'ায় টিকে থাকবার ক্ষমতা হারিয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়েছে। সেনাবাহিনী নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নির্যাতকের ভূমিকা হয়তো এখনো পালন করতে সক্ষম, এবং তা করতে গিয়ে সৈনিকতার মর্যাদা ধুলায় মিলিয়ে দিতেও হয়তো অনেকের দ্বিধা হবে না। কিন' এখন সেনাবাহিনী তার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি যেমন হারিয়েছে, তেমনি তার নৈতিক বলেরও ক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ, তার শক্তিও কম। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে নিজেকে রক্ষা করবার হিম্মত বাংলাদেশের কখনই হয়তো ছিল না। কিন' যে ন্যূনতম শক্তি ছাড়া একটি রাষ্ট্র নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে না, সেই শক্তিও বাংলাদেশ এখন হারিয়েছে। বাংলাদেশ এখন সব অর্থেই অরক্ষিত। এই কাজ পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে কি না সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন' যা ঘটে গিয়েছে সেই পরিসি'তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এখন আর সহজ নয়। বিশেষত সীমানে- কাঁটাতার ও নিরন-র কুকুরবিড়ালের মতো বাংলাদেশের মানুষ হত্যা, ফালানীর লাশ ঝুলে থাকা, পানির হিস্যা না পাওয়া, ভারতকে একতরফা করিডোর দিয়ে দেওয়া- ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি তা কিছুটা টের পাচ্ছি। তার পরেও দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মৈত্রী’র স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অনেকে আমাদের। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। 

তাহলে কী দাঁড়াল? ফেব্রুয়ারি আগে ছিল ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ চর্চার মাস। এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে অভিন্ন সম্পর্ক সমাজে এত দিন অনুমান করা হয়েছে সেখানে অনেক দিন থেকেই সঙ্গত কারণে চিড় ধরেছে। মুশকিল হচ্ছে এই জাতীয়তাবাদ আমাদের একটি অখ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে না, বরং ভয়াবহ বিভাজন ও বিরোধ সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিকতার পরিগঠনের দিক থেকে এই বিপদগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। আমরা টের পাচ্ছি তথাকথিত ‘জাতি’ সত্তা বা নানান কিসিমের জাতীয়তাবাদের কেচ্ছা ও কল্পনার ভূত থেকে মুক্ত হয়ে একটি অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের পরিগঠন করতে হলে আমাদের শত্রু-মিত্র নির্ধারণের মানদণ্ড বদলাতে হবে। হয়তো প্রথাগত জাতীয়তাবাদী ধারণা এই নতুন বাস-বতা মোকাবেলায় আমাদের আর কাজে লাগবে না। আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই কর্তব্য উপলব্ধি করবার সামর্থ্য আদৌ আমাদের আছে কি না সেটা পরীক্ষার একটা চমৎকার সময় হাজির হয়েছে। ঠিক। এই অর্থেও ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই। 

আত্মপরিচয়ের বিড়ম্বনার বিচারে মোটা দাগে দুই ধরনের জাতীয়তাবাদী ভূতে আমরা আক্রান-। এক হচ্ছে মুসলমানি ভূত। মুসলমানরাই এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অতএব মুসলমানিত্বই এই দেশের মানুষের একমাত্র পরিচয় হতে হবে। এই দাবি করতে গিয়ে ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির জটিল সম্পর্ক ও টানাপড়েন অন্যায় ভাবে অস্বীকার করা হয়। ইসলাম আরব দেশের ধর্ম। এর সঙ্গে আরবি ও আরব সংস্কৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ক। কিন' ইসলাম যখন এই দেশে এসেছে তখন তাকে এই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বিকাশের সুবিধা খুঁজতে হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল বিকাশ ঘটিয়েছে। ইসলাম কায়েমের মানে নিশ্চয়ই স'ানীয় ভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষা, কিম্বা স'ানীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে আরব সংস্কৃতি আমল করার মধ্যে পর্যবসিত করা নয়। যদি মুসলমানিত্বই আমাদের পরিচয় হয়ে ওঠে তখন সেখানে একটা অনাবশ্যক ও অস্বাভাবিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে এই উপমহাদেশে ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে শুধু নয়, জাতপাত শ্রেণীর পার্থক্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে তাকেও নাকচ করে দেওয়া হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এই উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস থেকে অভিন্ন নয়। এই আত্মপরিচয়ের ভূত একাত্তর সালে আমাদের কাঁধ থেকে নেমে যাবার কথা ছিল। পাকিস-ান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রাম এই ভূতকে কাঁধ থেকে নেমে যেতে বাধ্য করেছিল। তখন ইসলামের সঙ্গে আমাদের একটি ঐতিহাসিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হবার বিপুল সুযোগ তৈরি হয়। কিন' আমরা তা হেলায় হারিয়েছি। তাকে কাজে লাগাই নি।

কিন' ইতোমধ্যে আমাদের কাঁধে দ্বিতীয় ভূত চাপে। এই ভূত দাবি করতে থাকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়া আমাদের আর কোন পরিচয় নাই। ইসলাম তো নয়ই। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামকে শত্রু হিশাবে হাজির করতে থাকে। আগের ভূতের মতো এরাও উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকা বিশেষত জাতপাত-বিরোধী লড়াই এমনকি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামের ভূমিকাকে অস্বীকার করে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাদের অবস'ান হয় মূলত ইসলামের বিরোধিতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিজেদের গড়ে ওঠার ইতিহাসের দিকে আরো বিস-ৃত, ব্যাপক ও গভীর ভাবে তাকাবার সুযোগ করে দিয়েছিল, কিন' এই ভূত আমাদের আরো অন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি হোল, বাস-ব ইতিহাস নয়, একমাত্র ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের পরিচয়ের একমাত্র ভিত্তি। এক প্রকার ‘আবহমান বাংলা ও বাঙালির’ কল্পনা করা হয়, যাদের সঙ্গে কখনো ইসলামের মোলাকাত হয়েছে বলে প্রমাণ নাই। সকল নজির গরহাজির হয়ে যায়। ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতার বিপরীতে তৈরি হয় আরেক উগ্র ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক সামপ্রদায়িকতা। আমরা বাঙালি- এর অর্থ আদতে গিয়ে দাঁড়ায় ইসলাম-বিরোধী হওয়ার বীরত্বে, বাঙালির জীবনযাপন ও ইতিহাস থেকে ইসলামকে জবরদসি- বাদ দেওয়ার অস্বাভাবিকতায়। এমনকি ইতিহাস সম্পর্কে যাঁদের কাছ থেকে সচেতনতা আশা করা গিয়েছিল তাঁরাও অনায়াসে লিখলেন মুসলমানরা ঘরে ফিরে এসেছে, তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। যার প্রচ্ছন্ন অর্থ দাঁড়ায় এই জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে ধর্মান-রিত হয়ে ভুল করেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। নিজ দেশ সে ত্যাগ করে গিয়েছিল, এখন আবার প্রত্যাবর্তন করেছে। ইত্যাদি। 
আগের ভূত দেখল এতো ভারি সুবিধা। ইতিহাসের এই ফাঁকির জায়গায় যে ভূত আমাদের কাঁধ থেকে নেমে গিয়েছিল বলে একাত্তরে আমরা ভেবেছিলাম সেই ভূত আরো শক্তি নিয়ে আবার আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল। তারা সহজেই দাবি করতে পারল ‘বাঙালি’ হওয়ার কথা বলে আমাদের আসলে ‘হিন্দু’ বানানো হচ্ছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের চর্চার নজির দেখিয়ে এই প্রচারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা কঠিন ছিল না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কল্যাণে আমাদের কাঁধে এখন একটা নয়, দুই দুইটা ভূত এক সঙ্গে সওয়ার করেছে। মারহাবা। আমাদের হানাহানি রক্তপাত রাজনৈতিক বিভাজন ও অসি'তিশীলতার গোড়ায় রয়েছে এই দুই ভূতের কোন্দল। এই কোন্দল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাংলাদেশ আদৌ রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকতে পারে কি না সেটাই সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। 

যদি আমরা বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে দুই ধরণের ভূতের কারবার ছাড়তে হবে। এক হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র বিভাজন আর অন্য দিকে ধর্মের জায়গায় দাঁড়িয়ে শত্রু-মিত্র নির্ণয় করবার কারবার। অর্থাৎ এই দুই ধরণের সামপ্রদায়িকতা আমাদের শত্রু। এই দোষ ত্যাগ করলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ও আরবসভ্যতার সম্পর্ক নিজের গতিতেই এগুবে। রাজনৈতিকতার পরিমণ্ডলে কিম্বা রাষ্ট্র গঠনের পরিমণ্ডলে বারবার বিপদ ডেকে আনবে না। 

আমাদের উপলব্ধি করতে হবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে বাংলাদেশকে দুই ভাগে ভাগ করলে আমরা টিকে থাকতে পারব না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই বিভাজনের মীমাংসার জন্য যে ইতিহাস চেতনার দরকার আমরা তা অর্জন করি নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের দিক থেকে যদি দেখি তাহলে আমাদের সমস্যা আসলে মুসলমান বনাম বাঙালি হবার দ্বন্দ্ব নয়, বরং এই উপমহাদেশে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকবার সমস্যা। শুধু তা-ই নয়, এই উপমহাদেশে সকল নির্যাতিত জাতি, বর্ণ, শ্রেণীর পক্ষে লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করার মধ্য দিয়েই আমাদের বিকাশ ঘটবে। এই লড়াইয়ের জায়গায় দাঁড়িয়েই ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন করে বিচার ও বিবেচনা করতে আমাদের শিখতে হবে। 

আমার ধারণা, নিজেদের সংকট উপলব্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের জনগণ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। কিন' রাষ্ট্র গঠনের অন্যান্য প্রশ্ন মীমাংসার আগে বাংলাদেশের সামনে প্রধান বিপদ হিশাবে হাজির হয়েছে ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী বা সংক্ষেপে দিল্লি। দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কূটনৈতিক ভাবে মোকাবিলার সুযোগ নাই বললেই চলে। শুধু পানি নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধ আরো তীব্র হতে বাধ্য, যা মূলত পুরা উপমহাদেশকেই অসি'তিশীল করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান- পরিসি'তি এতোই নাজুক হয়ে উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিজেরাই উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে এখন। এই দিক থেকেও দুই হাজার নয় সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এবং তার পরিণতিতে সীমান-রক্ষী বাহিনী হিশাবে বিডিআরের পরিবর্তনকে বাংলাদেশের জনগণ সহজ ভাবে মেনে নিচ্ছে না। এর অভিপ্রকাশ কিভাবে ঘটবে এখনো তা পরিষ্কার নয়। রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রশ্ন যদি আসে তাহলে সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন' প্রথাগত সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশ রক্ষা অসম্ভব। বাংলাদেশকে অবশ্যই গণপ্রতিরক্ষার পথে অগ্রসর হতে হবে। এর সহজ মানে হচ্ছে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীকে নিলে চলবে না, এই দায়িত্ব সকল নাগরিককের। গণশক্তির লালন ও বিকাশ ছাড়া বিচ্ছিন্ন সামরিক শক্তি দিয়ে দিল্লির সঙ্গে মোকাবিলা সম্ভব নয়, বাস-ব পরিসি'তি এই সত্য উপলব্ধির জন্য এখন অনেক সহায়ক হয়ে উঠেছে। 

ফেব্রুয়ারি ভাষা ও সংস্কৃতির রাজনীতিকরণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে এতকাল ভাষা ও সংস্কৃতির মানদণ্ড দিয়ে বুঝতে চেয়েছে। আমার অনুমান, এই পর্যায় আমরা দ্রুত অতিক্রম করছি। দুই হাজার নয় সালের ২৫-২৬ তারিখের ঘটনাবলি ও তার পরিণতি বিচার করলে ফেব্রুয়ারি আমাদের গণপ্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভাববার জন্য তাগিদ দিয়ে যেতে থাকবে। 
ঠিক। ফেব্রুয়ারি আর আগের জায়গায় নাই। 
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২। ১২ ফাল্গুন ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

প্রতিরক্ষার কর্তব্য শুধু সেনাবাহিনীর নয়, প্রতিটি নাগরিকের



২০১২-০২-০২

দুই হাজার আট সালে নভেম্বরের শেষের দিকে আমি দৈনিক নয়া দিগন- (২৫.১১.২০০৮) পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল “সেনাবাহিনী থেকে ইসলামি ভূত তাড়ানোর ‘সেকুলার প্লান”। হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ নামক পত্রিকায় ১৯ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ইরাক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন সামরিক অফিসার কার্ল সিওভাক্কো যৌথ যে নিবন্ধ লিখেছিলেন সেটা পড়ে বাংলাদেশে কী ঘটতে পারে তার একটা আন্দাজ করতে চেয়েছিলাম। সজীব ওয়াজেদ জয় একজন ব্যক্তিমাত্র নন। তিনি শেখ হাসিনার সন-ান, ফলে মায়ের চিন-াচেতনা ও ধ্যানধারণার ওপর তার একটা প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। কিন' রক্তের সম্পর্ককে আমি গুরুত্ব দিয়ে দেখি নি। বরং গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি তার আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পদে থাকা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে কী করবেন তার একটা আগাম পাঠ ওই লেখার মধ্যে ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের বদৌলতে কোনো একটি দল ক্ষমতায় আসা মানে মূলত একজনের রাজত্ব বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন বলবৎ করা। যে কারণে দলীয় প্রধান হিশাবে যিনি ক্ষমতায় আসেন তিনি নিজেকে বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিপতি বলেই মনে করেন। যিনি মনে করেন দোষ তো তার নয়। যদি সংবিধানেই আমরা সে ব্যবস'া রেখে দিই তাহলে অপরাধ তো আমাদেরই। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান- বিশেষত ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে ক্ষমতার চরিত্র একনায়কতান্ত্রিক হতে বাধ্য। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না, তেমনি নির্বাচন করলেই এ ধরনের সংবিধানের একনায়কী আবর্জনা সাফ হয় না। এই একনায়কী শাসনকে সাংবিধানিক ভাবে বোঝার জন্য একে ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র’ বলা যায়। আমার লেখালিখিতে সব সময় তাই বলে এসেছি এবং বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ভাবে গড়বার জন্য নতুন একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) কেন দরকার বিভিন্ন সময় তার যুক্তি হাজির করেছি। 

তাহলে সাংবিধানিকভাবে সিদ্ধ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিশাবে মার্কিন সামরিক অফিসার কার্ল সিওভাক্কোর সঙ্গে সজীব ওয়াজেদ জয় যে পরিকল্পনা হাজির করছেন তাকে বাস-বায়ন করা মোটেও কঠিন কিছু নয় বলেই আমার মনে হয়েছিল। একনায়কী শাসনের এই এক সুবিধা। লিখেছিলাম জয়-সিওভাক্কোর নিবন্ধটি পড়ে ‘আমরা উপকৃত হয়েছি। কারণ বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটবে তার একটা আগাম সংকেত পেয়েছি আমরা’। সেই সংকেতটা কী সেটাই আমি আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এখানে সেই লেখার পুনরাবৃত্তি করব না। আমার অনুমান ঠিক ছিল কি না সেটা পাঠক এখন আবার পড়ে এখনকার ঘটনা নিজেই বিচার করে দেখতে পারেন। 

বলাবাহুল্য সেই আগাম সংকেত পাবার পরেও বাংলাদেশ নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে কি না, কতটুকু পেরেছে বা না পারলেও তার আশু কর্তব্যগুলো কী হতে পারে সে বিষয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ভাবা দরকার। সেনাবাহিনীর ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুথান’কে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগ যেভাবে সেনাবাহিনীর কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা কর্তৃক অন্যদের দুরভিসন্ধিমূলক ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে... বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করা অর্থাৎ শেখ হাসিনার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালিয়েছে বলে ছকে বাঁধা প্রচার করেছে সেই প্রপাগান্ডা কাজ করে নি। সেনাবাহিনীতে কোন ‘বিশৃংখলা’ বা অভ্যুত্থানের চেষ্টা কোন ‘ধর্মান্ধ কর্মকর্তা’ করল নাকি কোন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কর্মকর্তা করল- প্রতিষ্ঠান হিশাবে তাতে কিছু আসে-যায় না। সেনাবাহিনীর দিক থেকে শৃংখলা ভঙ্গ করলেই- সেটা ধর্মের নামে হোক, কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হোক- কিম্বা হোক জাতিকে দুই নেত্রীর কবল থেকে বা দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত করবার কথা বলে ক্ষমতা দখল করবার চেষ্টা- যে ছুতাতেই হোক সেটা সেনা আইনে অপরাধ। সেনাবাহিনী তাদের বিচার করতে বাধ্য। 

দেশের ভেতরে এই ছকে বাঁধা প্রচারের ফল কী হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। আমার অনুমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই প্রচার বিশ্বাস করে নি। তবে আসলে কী ঘটেছে জানার আগ্রহীর সংখ্যা কম নয়। এটাও বোঝা যায় চট্টগ্রামে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার কিছু বক্তব্যের সূত্র ধরে তাকে অভিযুক্ত করবার আওয়ামী কৌশলও কাজ করে নি। কিন' বিএনপির আঠারোই ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে যে সহিংসতা ঘটেছে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ উঠেছে, তার দাগ বিএনপি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না। এই অনুমান অনেকের মধ্যেই দানা বেঁধেছে যে দ্রুত ক্ষমতায় যাবার আশায় এই দলের মধ্যে কিছু হঠকারী শক্তির সমাবেশ ঘটেছে। এরা হয়তো বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই কিছু একটা করে ফেলতে চায়। বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস-বতার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার পণ্ড করবার জন্য জামায়াতে ইসলামী নৈরাজ্যের রাজনীতি উসকে দিতে পারে- অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল আশংকা রয়েছে। তাদের মধ্যে এই ছকে বাঁধা প্রচারকাজ করেছে। তবে এই প্রচারের পক্ষে সবচেয়ে বড় ইন্ধন জুগিয়েছে হিযবুত তাহরীরের পোস্টার ও প্রচারপত্র। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন- যুদ্ধের অংশীদার বাংলাদেশের সুশীলসমাজ এই সকল পোস্টার ও প্রচারপত্র আশ্রয় করে বাংলাদেশে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বিভাজন-রেখাকে আরো মোটা ও দৃশ্যমান করে রাখবার আরেকটি ভালো সুযোগ পাবে। তারা তাদের সমস- প্রতিভা দিয়ে তার সদ্ব্যবহার করবে। তাদের পত্রিকায় সেই অবিরত চেষ্টা আবার শুরু হয়ে গিয়েছে। এই প্রচারে হিযবুত তাহরীরের নগদ লাভ হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের একটা বড় অংশ তাদের কীর্তিতে অনুপ্রাণিত বোধ করবে। দলের শক্তি এতে বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা আছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে সদস্য সংগ্রহের সাফল্য ও অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রয়াসের যে কীর্তিকথা সেনাসদরের তরফে প্রচার করা হয়েছে, তাতে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এই দলের পরিচিতি বাড়বে। এর মধ্য থেকে সেই পুরানা শিক্ষাটা আমাদের নতুন ভাবে পাঠ করতে হবে যে যারা মৌলবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাসের কথা বলে তারা সেটা নানান কায়দায় তৈয়ারও করে। কেউ সজ্ঞানে, কেউ না জেনে। কিন' করে। 

কিন' আন্তর্জাতিক ভাবে এই প্রপাগান্ডা গ্রহণযোগ্যতা পায় নি সেটা পরিষ্কার। হতে পারে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পরেও কুশাসন, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, দুর্নীতি, ক্রমাগত মানবাধিকার লংঘন, মানুষ গুম করে ফেলা ইত্যাদি কারণে মহাজোট সরকারের অযোগ্যতা এতই প্রতিষ্ঠিত যে, এই প্রচারকে সেই আযোগ্যতা ঢাকা দেওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা হিশাবেই দেখা হয়েছে। সীমানে- হত্যা ও কিশোরী ফালানীর মতো নিষ্পাপ মেয়েদের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা এবং বিএসএফের মানুষ উলঙ্গ করে নির্মম ভাবে পেটানোর পরেও দিল্লির প্রতি শেখ হাসিনার সরকারের মনোভাব এটাই প্রমাণ করেছে যে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের যদি স্বাধীন আঞ্চলিক ভূমিকার কোন সম্ভাবনা থেকেও থাকে এখনকার ক্ষমতাসীনদের দিয়ে তার বাস-বায়ন সম্ভব নয়। এই সরকারের প্রতি আন-র্জাতিক সমর্থন এই কারণেও কমছে। তা ছাড়া সেনাতরফে যে লিখিত বক্তব্য হাজির করা হয়েছে, তার দলীয় চরিত্র এতই স্পষ্ট যে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলন ও লিখিত বক্তব্যের গুণেই কর্পূরের মতো হাওয়ায় উবে গিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে এখন অনেক বেশি উন্মুখ। সৈনিকতার মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠানের পেশাদার চরিত্র বহাল রাখবার অক্ষমতাও প্রকট হয়ে উঠেছে। নিজেদের মর্যাদা তারা নিজেরাই মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।
বিএনপি, জামায়াত, হিযবুত তাহরীর ও ‘সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা’ বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টা করেছে, এই চেষ্টা যে আন-র্জাতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য হয় নি দিল্লি সেটা অনায়াসেই টের পেয়েছে। এই প্রথম দিল্লির পক্ষে প্রচার খুব একটা কাজে আসে নি। এরপর দিল্লির স্বার্থ বজায় রাখতে হলে প্রচারের ধরন কী হতে পারে সেটা খুঁজতে গিয়ে গালফ নিউজে কুলদীপ নায়ারের লেখাটি পড়েছি। কুলদীপ লেখাটি লিখেছেন জানুয়ারির ২৮ তারিখে, সেনাসদরের তরফে ১৯ তারিখে সংবাদ সম্মেলন করবার ৯ দিন পর। তত দিনে সংবাদ সম্মেলনের আঞ্চলিক ও আন-র্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা হয়ে যাবার কথা। দেখলাম কুলদীপ শুরুই করেছেন ভারতীয় গোয়েন্দাদের কীর্তির সাফাই গেয়ে। লিখছেন, ‘অভ্যুত্থান বা ষড়যন্ত্রের চেষ্টা ঘটে যাবার ওপর ধূলাবালি থিতু হয়ে যখন বসল তখন নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'াগুলো সেনাবাহিনীর ওপরওয়ালাদের কাছে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। এই বার বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সময়মতো কাজ করে আর বিদ্রোহ অংকুরেই পিষে ফেলে।’ তাঁর দাবি, এর আগেও ১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'াগুলো সেনাবাহিনীকে সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানিয়েছিল, কিন' তখন যেহেতু সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই অভ্যুত্থানের হোতা ছিলেন, অতএব সেই সতর্কতায় কাজ হয় নি। শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিবারবর্গের অনেক সদস্য সঙ্গে নিয়ে নিহত হয়েছেন। 

কুলদীপ বলছেন, সেনাবাহিনী যে ক্ষমতা নিতে চায় না তার প্রমাণ হোল কিছু দিন আগে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ফিরে এলে তার হাত ধরে আবারও দুর্নীতি ফিরে আসবে এটা জানা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছে। বিএনপি বা চারদলীয় জোট যদি ক্ষমতায় আসত তাহলে এই কথা কুলদীপ বলতেন কি না সন্দেহ। এবারের বিশৃংখলা বা অভ্যুত্থানের মতো কুকাজ যে সেনাবাহিনীর মধ্যে ধর্মান্ধ লোকজনই করেছে, সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন কুলদীপ। এই ধরনের লোকজন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যেমন আছে, বাংলাদেশেও ঢুকে পড়ছে। সেনাসদরের তরফে সংবাদ সম্মেলনে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে কুলদীপ নায়ারের বক্তব্যের বিশেষ অমিল নাই। কিন' কুলদীপ নতুন একটি তথ্য যোগ করেছেন সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। 

তিনি বলছেন, “আমার কাছে এমন তথ্য আছে যে,এবার অভ্যুত্থানের নেতারা এমন কিছু শক্তির কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে যারা ভারত থেকে তৎপরতা চালায়। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসমের (উলফা) একটি অংশ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। কথাটা খাটে বৈরী নাগাদের বেলায়ও। মনিপুরের বিদ্রোহীরাও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। এটা বিস্ময়কর যে, বাংলাদেশ এখন তার ভূখণ্ড থেকে কোনো ভারতবিরোধী শক্তিকে তৎপরতা চালাতে না দিলেও ভারত এ ক্ষেত্রে ঢিলেমি ও নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় দিচ্ছে।”

এই ‘তথ্য’টা নতুন। সেনাসদরের তরফে যে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই ধরনের কোন অভিযোগ নাই। বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে নয়, বাংলাদেশের সেনা অভ্যুত্থানের নেতাদের সাহায্য করেছে ভারত থেকে উলফার একটি অংশ, বৈরী নাগা ও বিদ্রোহী মনিপুরিরা। কুলদীপ নায়ার তার কাছে এই তথ্য আছে বলে দাবি করেছেন, অতএব এই বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নাই। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, তদনে-র স্বার্থে তিনি এই তথ্য গোপনও রাখতে পারতেন। কিন' তা করেন নি। প্রশ্ন হচ্ছে, ফলাও করে এই তথ্য প্রচার করছেন কেন?
যেটা বুঝতে পারি, কুলদীপ নায়ার প্রমাণ করতে চান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে যা কিছু ঘটছে সেটা বাংলাদেশের অভ্যন-রীণ ব্যাপার মাত্র নয়, সেটা ভারতের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা গেলে শেখ হাসিনাকে ‘সব রকমের সাহায্য’ দেবার পক্ষে ভারত অনায়াসেই আন-র্জাতিক যুক্তি ও বৈধতা খাড়া করতে পারে। ভারতের এই সবরকম সাহায্যের মধ্যে বাংলাদেশে গোয়েন্দা ও সামরিক হস-ক্ষেপও অন-র্ভুক্ত। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অভ্যন-রের কোন তৎপরতা যদি ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়, তাহলে বাংলাদেশে হস-ক্ষেপ করবার অধিকার আছে ভারতের। ভারতের বিরুদ্ধে প্রধান একটি অভিযোগ হচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতা। বাংলাদেশের সেনা অফিসারদের ভারতীয় গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে- এই অভিযোগ খুবই স্পর্শকাতর। এই অভিযোগের বিপরীতে ভারতের পক্ষে কুলদীপ একটা যুক্তি খাড়া করতে চাইছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিদ্রোহী, উলফা, নাগা ও মনিপুরিদের যোগসাজশ আছে বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান। যদি তা-ই হয় তাহলে ভারত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার স্বার্থে বাংলাদেশে যে-কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। ক্ষমতাসীন সরকার দিল্লির মিত্র। হয়তো সরকারের কাছে অনুমতি নিয়েই তারা তা করছে। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কিছু ঘটলে ভারত যে চুপ করে থাকবে না সেই দিকটাও তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন। 
সেনাবাহিনীতে ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুত্থান’ ঘটাবার কোন প্রয়াস থাকুক বা না থাকুক, বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর থেকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় নীতি আগাগোড়া ভারতের প্রতিরক্ষা ও সামরিক নীতির অধীনস'। দুই দেশের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করা, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে করিডোর দেওয়া, বিডিআরকে ‘বর্ডার গার্ড’ অর্থাৎ সীমানে-র দারোয়ানে পরিণত করা ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যেই আমরা সেই নীতিরই বাস্তবায়ন দেখি। এই অভ্যুত্থানের প্রয়াসকে দিল্লি একটি বিশাল সুযোগ হিশাবে গ্রহণ করবে। কুলদীপ অবশ্য সেটা খোলামেলাই বলেছেন, ‘এবারকার ব্যর্থ অভ্যুত্থান শুধু একটি সতর্ক বার্তাই নয়, একই সাথে দিল্লি সরকারের জন্য ছিল একটি সুযোগও’। তিনি ঠিকই ধরেছেন এবং ঠিকই বলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমরা এক শ’ ভাগ একমত হতে পারি। অবসর ও বদলির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে যে অদলবদল চলছে, সেই রূপান-রের প্রক্রিয়া এখন ত্বরান্বিত হবে। সেনাপতি মইন ইউ আহমেদের সময় থেকে ভারতের সামরিক ও প্রতিরক্ষানীতির বাইরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর স্বাধীন কোন অসি-ত্ব আশা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। এখন তা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। যেটা আমাদের বুঝতে হবে, কারো কারো জন্য যতই বেদনাদায়ক হোক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটা সংস্কার বা পুনর্গঠন চলছে। সেই ক্ষেত্রে কেউ ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুত্থান’ সৃষ্টির ব্যর্থ প্রয়াসে অংশগ্রহণ করে সেই পুনর্গঠনের ফাঁদে পা দিচ্ছে, আর কেউ সেই প্রয়াস দমন করে পুনর্গঠনকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলছে। 

গত বছর নভেম্বরের ২৬ তারিখে কুলদীপ নায়ার গালফ নিউজেই আরেকটি লেখা লিখেছিলেন। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে, এই বাস-বতা টের পাবার জন্য তাঁকে জেগে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি (Hasina has to wake up to the reality)। তবে প্রধানমন্ত্রী তার পরামর্শে জেগে ওঠেন নি, এটা নিশ্চিত। এবারের লেখাতেও তিনি স্বীকার করেছেন যে শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের মোহ কেটে গিয়েছে। কিন' দিল্লিকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা যে বাংলাদেশের পাশেই থাকবে এটা যেন তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধ কূটনৈতিক মীমাংসার বাইরে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। দিল্লির সঙ্গে পানির বিবাদ মিটবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অসম বাণিজ্যের পার্থক্য বাড়তেই থাকবে, কমবার কোন সম্ভাবনা নাই। সীমানে- বিএসএফের হত্যা ও নির্যাতন কমবে না। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের সুযোগ কমবে। ইত্যাদি নানা কারণে দিল্লির বিরোধিতার রাজনীতি বাড়বে। হয়তো বাংলাদেশের প্রতি এটাই দিল্লির নীতি। যাতে দিল্লির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভ আরো বাড়ে এবং তার পরিণতিতে দিল্লির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধও আরো প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আর তখন যেকোন প্রতিরোধকেই ধর্মান্ধদের চেষ্টা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে ইসলামি মৌলবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাসীদের হামলা হিশাবে অভিহিত করা দিল্লির পক্ষে সহজ হবে। ইসলামের নাম নিয়ে নতুন-পুরাতন বড়-ছোট অনেক দল তখন পাওয়া যাবে যারা জেনে বা না জেনে দিল্লির ফাঁদে পা দেবে। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা দিল্লির পক্ষে তখন অনেক সহজ হবে। সমাজের সর্বত্র ক্ষোভ-বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে। তার প্রকাশ কোথায় কিভাবে ঘটবে আমরা জানি না। সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করবার আহাম্মকি বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে।

বলাবাহুল্য বাংলাদেশ একটি সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। এর পরিণতি কী দাঁড়ায় আমরা এখনো সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে প্রপাগান্ডায় বিশ্বাস না করা। আসলে কী ঘটছে সেই দিকে আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা প্রথম কাজ। এখন এই উপলব্ধিটুকু দরকার যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার কর্তব্য শুধু সেনাবাহিনীর নয়, প্রতিটি নাগরিকের। কিন' বিদ্যমান সংকট আমরা অচিরেই সমাধান করতে পারব না। কারণ এখনো রাষ্ট্রগঠন ও গণপ্রতিরক্ষার প্রশ্নকে আমরা জাতীয় প্রশ্ন হিশাবে তোলা ও তার মীমাংসার জন্য তৈরি হতে পারি নি। আমাদের রাজনীতির প্রধান ইস্যু এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা-না-থাকা এবং তার অধীনে নির্বাচন হওয়া-না-হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। মহাজোটের পরিবর্তে চারদলীয় জোটকে ক্ষমতায় বসানোর মধ্যে কোন সমাধান নাই। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে বলে মনে করে, ফলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। কিন' ক্ষমতায় গেলে তারা কী করবে তার কোন ইঙ্গিত, ইশারা বা প্রস-াব নাই। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে বাংলাদেশকে এক দিকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা এবং অন্য দিকে রাষ্ট্র হিশাবে গড়ে তুলবার যে একটা কর্তব্য রয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে আমরা চরম ভাবে উদাসীন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস'ান গড়ে তোলাই এখনকার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমরা একক সত্তা নই। দলবাজি ও মতাদর্শিক গোঁড়ামির বাইরে আসতে হলে আমাদের নিদেনপক্ষে এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু দরকার যে রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে শক্তি ও সৈনিকতার ভূমিকাকে আমরা যেন কোনভাবেই খাটো করে না দেখি। ঠিক যে প্রথাগত সেনাবাহিনী বিত্তবানদের সম্পত্তি পাহারা দেয়। ধনীর পক্ষ হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। গুলি ছোড়ে। কিন' দেশ ও জনগণের স্বার্থের পাহারাদারি ও সুরক্ষার জন্য কিভাবে শক্তি ও সৈনিকতার পুনর্গঠন করা যায়- সেই ব্যবহারিক আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দলবাজির নোংরামি ও মতাদর্শিক গোঁড়ামির খানাখন্দ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি। নইলে বড় ও ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের দাসানুদাস থাকাই হয়তো আমাদের নিয়তি হয়ে উঠবে। তার নমুনা কেমন হতে পারে তার স্বাদ গত তিন বছরে আমরা পেয়েছি। 
হয়তো দাসত্বতেই আমরা আরাম বোধ করি। কে জানে। ভবিষ্যৎই তার উত্তর দেবে। 
১ ফেব্রুয়ারি ২০১২। ১৯ মাঘ ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

সরকারের ভারত নীতিই দায়ী



২০১২-০১-৩১

'Bangladesh has faced dozens of coups, failed or not, in its 40 years. But for an army spokesman to give details of one, on January 19th, was unusual’. -- `Politics in Bangladesh; 
Turbulent House. The army claims to have thwarted a coup'. 
ECONOMIST. 20 January 2012.
ব্যর্থ হোক আর না হোক, কয়েক ডজন অভ্যুত্থান গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে গত ১৯ জানুয়ারি তারিখে একজন সেনা মুখপাত্রের এক অভ্যুত্থানের বিস-ৃত বর্ণনা দেওয়া খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার (ইকোনমিস্ট, ২০ জানুয়ারি ২০১২)।

গত দিনের এই লেখার প্রথম কিসি-তে বোঝাতে চেয়েছি ‘বিশৃংখলা’ এবং ‘অভ্যুত্থান’ আক্ষরিক দিক থেকে সমার্থক নয়, এটা আমরা সহজেই বুঝি। কিন' সেটা গুর"ত্বপূর্ণ নয়। আসল গুর"ত্ব হ"েছ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধান ও আইনের দিক থেকে উভয়ের পার্থক্যের তাৎপর্য। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টায় বেসামরিক কেউ জড়িত থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি ঠিকই বলেছেন, ‘সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর পরে সংবিধান ও আদালতের বির"দ্ধে সংঘটিত এ ধরনের অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল’ (মানবজমিন, ২৯ জানুয়ারি ২০১২)। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী অপরাধীরা সেই ক্ষেত্রে ‘সর্বো"চ দণ্ডে দণ্ডিত’ হবে, অর্থাৎ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। 
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কিছু সময় পরে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস'া বাসস খবর জানায় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে মন-ব্য করেছেন। তিনি সম্ভবত এই সংবাদ সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শনিবারও প্রধানমন্ত্রী আবার ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। শুক্রবার রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং পরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনিসহ মন্ত্রিসভার আরো অনেক সদস্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করবার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করতে থাকেন। অর্থাৎ সেনাসদরের তরফে সংবাদ সম্মেলনে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তারা সেই অভিযোগটাকেই বিএনপির বির"দ্ধে রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করতে শুর" করেন। 
জানুয়ারির ২০ তারিখে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে দুটো ব্যাপার খোলাসা হয়ে যায়। তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : ‘উঠেছে খালেদা-পুত্রের নাম : ষড়যন্ত্র হলে হাসিনার পাশেই থাকবে দিল্লি’। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হোল, ‘শেখ হাসিনাকে সরানোর চেষ্টা হলে, তাকে সব রকম সাহায্য করার সিদ্ধান- নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বাংলাদেশ সরকারকেও সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে’। শেখ হাসিনার পক্ষে কোন দেশ থাকুক বা না থাকুক গণতান্ত্রিক ভাবে সরকার পরিবর্তনের যে নির্বাচনী নীতি রয়েছে তার বরখেলাফ করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হোলে বিশ্বের সব দেশই নিন্দা করবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ সেনা অভ্যুত্থান আদৌ সমর্থন করবে কি না সন্দেহ। কিন' আনন্দবাজার বলছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাবার চেষ্টা হলে দিল্লি তাকে ‘সবরকম সাহায্য’ করবার সিদ্ধান- নিয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। তার মানে কি এই যে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য দিল্লি সেনাবাহিনী পাঠাবে? 
‘সবরকমের সাহায্য বলতে এটাও বোঝায়। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আনন্দবাজার খোলাসা করে দিয়েছে সেটা হোল- বাংলাদেশে দিল্লির গোয়েন্দা নজরদারি তীক্ষ্ণ। মূলত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'ার সহায়তাতেই সেনা অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিশৃংখলা বা অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেবার ক্ষেত্রে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সহযোগিতা ছিল। তাদের ভাষায়, ‘সেনা অভ্যুত্থান ভেসে- দেওয়ার পিছনে ভারতের তরফ থেকেও গোয়েন্দা তথ্য ছিল’। বলা হয়েছে, ‘হিজবুত তাহরীর, জামাতে ইসলাম ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একজোট হয়ে কাজ করছে। গোটা ঘটনার মাথা হিসেবে উঠে আসছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের নামও।’ এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা সেটা বিচার করা আমাদের কাজ নয়। তদন- চলছে, এই বিষয়ে তদনে-র স্বার্থে আমাদের নীরব থাকাই সমীচীন। কিন' আনন্দবাজারের এই তথ্যের গুর"ত্বপূর্ণ দিক হ"েছ- এই অভিযোগ শুধু বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের নয়। দুই দেশের গোয়েন্দাদেরই যৌথ তথ্য এটা। দুই দেশের গোয়েন্দারা যে একজোট হয়ে কাজ করছে, তারই ভিত্তিতে আনন্দবাজার এই খবর ছেপেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার এই প্রতিবেদনের বির"দ্ধে সেনাসদর থেকে কোন প্রতিবাদ আমার চোখে পড়ে নি। 
এবার যদি পুরা ঘটনা প্রকাশ হবার আগে ফিরে যাই তাহলে দেখব বিডিআর হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা, দেশের সামগ্রিক পরিসি'তি এবং পেশাগত স্বার্থের ক্ষোভের কথা বাদ দিলে সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অসি'রতা ও ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির প্রধান কারণ। তা ছাড়া বাংলাদেশ সীমানে- ক্রমাগত বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন তো আছেই। সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনের পরদিনই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন পরিসি'তি অনুধাবন করতে আমাদের খুব কাজে আসে। 
আমরা জানি, মেজর জিয়াউল হক নিজেকে ৪১ বিএমএ লং কোর্সের একজন অফিসার দাবি করে ফেসবুক ও ইন্টারনেটে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। ফেস বুক ও ইন্টারনেটে প্রচারিত মেজর জিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী তাঁকে একটি গোয়েন্দা সংস'ার সদস্যরা অপহরণ করেছিল। দুই দিন দুই রাত আটক রাখার পর কৌশলে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এটা তাঁর দাবি, কিন' ঘটনার জটিলতা এখান থেকেই শুর"। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কোর্স শেষে বদলিকৃত রেজিমেন্টে যোগদানের পথে তিনি অপহৃত হন বলে তিনি তার লেখালিখিতে দাবি করেন। তুলে নেয়ার পর অজ্ঞাত স'ানে রেখে চোখ বেঁধে তাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার প্রকাশিত বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি পাশের একটি দেশের গোয়েন্দা সংস'ার সদস্যও উপসি'ত ছিল সেখানে। দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাশের রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস'ার সদস্যরা এমন কিছু তথ্য মেজর জিয়ার কাছে জানতে চেয়েছে, যা একটি স্বাধীন দেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন- সংবেদনশীল বলে মেজর জিয়া তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। তার প্রকাশিত লেখায় তিনি আরো বলেন, লে. কর্নেল যায়ীদ, লে. কর্নেল হাসিন ও লে. কর্নেল এহসান ইউসুফ নামে আরো তিন সেনা অফিসারকে গ্রেফতার দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। 
এই লেখা ইন্টারনেটে ছড়াতে থাকে। দৈনিক আমার দেশ ৩ জানুয়ারি তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঘটনাটির সত্যতা নির্ণয় করবার জন্য তারা সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে ও মেজর জিয়ার লেখায় উল্লিখিত বাসার ঠিকানায় যাবার চেষ্টা করে বিফল হয়। গেটে বসিয়ে রেখে তাদের বলা হয়, সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ। জানানো হয়, ওপরের কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি ছাড়া যাওয়া যাবে না। পত্রিকাটি ২ জানুয়ারি বিকাল ৩টা ৪৭ মিনিটে আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগেও মেজর জিয়ার অভিযোগগুলোর সত্যতা জানতে ফোন করে। তখন পত্রিকাটিকে জানানো হয়, আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগ থেকে কিছুই বলা যাবে না। সেনা সদর দফতর বা সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতর মেজর জিয়ার বিষয় জানাতে পারবে বলে জানানো হয়। 
সেনা অফিসারদের বিনা বিচারে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বন্দি করে রাখা প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ সাবেক সেনাকর্মকর্তা এবং এখন সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের কাছে তাঁর মতামতও জানতে চায়। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘১৫০ দিনের বেশি সময় ধরে লে. কর্নেল পদমর্যাদার দুই অফিসার আটক আছেন বলে তিনিও জানতে পেরেছেন। তিনি আরো বলেন, যতটুকু জানি এদের একজন গত ৯ জুলাই ও আরেকজন ১২ জুলাই কর্মরত অবস'ায় গ্রেফতার হন। তবে তাদের বির"দ্ধে কোনো বিচার শুর" হয়নি। সেনা বিধান অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়া এবং সেই বিধান ও প্রক্রিয়ার অধীনে প্রযোজ্য মানবাধিকার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হ"েছ, ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্টের ৭৫ ধারা অনুযায়ী, অভিযোগের ভিত্তিতে সেনা অফিসারদের গ্রেফতার করা যায়। এ ধারায়ই বলা আছে, গ্রেফতারের ৮ দিনের ভেতর কোর্টমার্শাল গঠন করতে হবে। ৮ দিনের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব না হলে উপযুক্ত কারণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। তিনি বলেন, আইনেই বলা আছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠন করতে না পারলে আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করে দিতে হবে। ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, ১৫০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের বির"দ্ধে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। এতে অনুমান করা যায় প্রমাণ করার মতো কোনো অভিযোগ এ অফিসারদের বির"দ্ধে নেই। প্রমাণের মতো অভিযোগ থাকলে কোর্ট মার্শাল গঠন হয়ে যেত।’
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা সত্যতা নির্ণয়ের এই অভিজ্ঞতা এবং সেনা অফিসারদের গ্রেফতারের পর ১৫০ দিন পেরিয়ে যাবার পরেও কোন কোর্টমার্শাল গঠিত না হওয়া সম্পর্কে ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের বক্তব্য প্রতিবেদন হিশাবে প্রকাশ করার পরই গত ৪ জানুয়ারি আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে, ই-মেইলে অপহরণের অভিযোগকারী মেজর জিয়ার বির"দ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর আগে তারা কিছু বলেন নি। ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমআইএসটি থেকে কোর্স সম্পন্ন শেষে বদলিকৃত ইউনিট ৩ই বেঙ্গলে যোগদানের জন্য মেজর জিয়াকে যাবার আদেশ দেয়া হয়। পরে সেনা শৃঙ্খলাপরিপন'ী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে তখন সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়া, ঢাকা সেনানিবাসে সংযুক্তি আদেশ প্রদান করা হয়। এই আদেশ অনুযায়ী মেজর জিয়া সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়ায় যোগদান না করে পলাতক রয়েছেন; এই কারণেই সেনা আইন অনুযায়ী এরই মধ্যে তার বির"দ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল যায়ীদ ও লে. কর্নেল হাসিনকেও শৃঙ্খলাপরিপন'ী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে সেনা আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপরই গত ১১ জুলাই ২০১১ তারিখে একটি উ"চপর্যায়ের তদন- আদালত গঠন করা হয়। আদালত সুষ্ঠু তদন- শেষে তাঁদের বক্তব্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন এবং উক্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে লে. কর্নেল হাসিনের বির"দ্ধে ১১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে একটি ফিল্ড জেনারেল কোর্টমার্শাল গঠন করা হয়; তার বিচারকার্যক্রম চলছে। এই বক্তব্যে দেখা যায়, আট দিনের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠনের বিধান পালিত হয়েছে কি না সেই মৌলিক প্রশ্নটা উহ্য। এই বিধান পালিত না হলেও আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পত্রিকায় উল্লিখিত ‘অভিযুক্ত অফিসারদের বির"দ্ধে কোনরূপ বিচারকার্যক্রম শুর" হয়নি এবং ১৫০ দিন পার হওয়ার পরও তাদের বির"দ্ধে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি’ মর্মে প্রকাশিত বক্তব্য সঠিক নয়। 
এরপর গত ৫ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশে আন-ঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের বরাত দিয়ে ‘মেজর জিয়ার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে’ শীর্ষক আইএসপিআরের বক্তব্যের একাংশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন লে. কর্নেল যায়ীদের ছোট ভাই আ. আ. জাবিদ। এক প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি জানান, তার ভাই যায়ীদ পিএসসি, এমডিএস, এসএ, বিএসবিএএ (এমআইএস, টি.আইবিএ)-কে গত ১০ জুলাই ২০১১ তারিখে ছুটিতে থাকা অবস'ায় পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের সরকারি বাসভবন থেকে তুলে নেয়া হয়। তিন-চার দিন পর পরিবারের লোকজন বিষয়টি জানতে পারেন। সেই থেকে প্রায় ছয় মাস বা ১৮০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অদ্যাবধি তার ভাইয়ের বির"দ্ধে কোনো চার্জ বা অভিযোগ আনতে পারে নাই। তাই যায়ীদ সম্পর্কে আইএসপিআরের বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য ও বিভ্রানি-মূলক। আ. আ. জাবিদ তার প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলেন, সামরিক কর্মকর্তাকে তদনে-র জন্য আটক করার প্রয়োজন পড়ে না। তাকে শুধুমাত্র লগ এরিয়াতে অ্যাটাচমেন্ট করলেই হয়। একটি কক্ষে বহুসংখ্যক সৈনিক দ্বারা তালাবদ্ধ অবস'ায় কেন লে. কর্নেল যায়ীদকে আটক রাখা হয়েছে- এর ব্যাখ্যা চান তিনি। 
পত্রিকায় আমি যেভাবে পড়েছি সেভাবেই বিষয়গুলো হাজির করছি। আমরা দেখছি পুরা ঘটনাঘটনের মধ্যে মূল বিষয় হ"েছ- এক. সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সক্রিয় ভূমিকা আনন্দবাজার পত্রিকার বক্তব্যের সঙ্গে যার কোন অসঙ্গতি নাই; দুই. সেনা আইনের অধীনে সৈনিকদের সামরিক আদালতে সুবিচার পাবার অধিকার- যা মানবাধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত এবং তিন. বিচার ছাড়া আটক রাখা এবং আটক রাখার পরেও অভিযুক্তের আত্মীয়-স্বজনদের তা না জানতে দেওয়া বা অস্বীকার করা।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের ভূমিকা শুধু সেনাবাহিনীর উদ্বেগের বিষয় নয়, বাংলাদেশের যেকোন নাগরিকেরই উৎকণ্ঠার বিষয়। গুজব মাত্রই সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষতিকর। দৈনিক আমার দেশ সকল প্রকার গুজব নিরসন করবার জন্যই আসলে সেনাবাহিনীতে কী ঘটছে তা সেনাবাহিনীর কাছেই জানতে চেয়েছে। কিন' নাগরিকদের উৎকণ্ঠা নিরসন করবার জন্য দৈনিক আমার দেশের ভূমিকাকে দমন করবার জন্য প্রথমে যে কাজটি করা হয় সেটা হোল- মামলা। গত ৮ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি খর্ব ও সম্মানহানির অভিযোগ এনে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, প্রকাশক আলহাজ মো: হাসমত আলী ও বিশেষ প্রতিনিধির বির"দ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন একজন সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর (অব:) শাহ আলম তালুকদার। মামলায় তার অভিযোগ হ"েছ- ৩ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘মেজর জিয়াকে নিয়ে রহস্য’ শিরোনামের সংবাদে বলা হয়েছে, মেজর জিয়া সম্পর্কে জানতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে দৈনিক আমার দেশকে বলা হয়, পরিচালক সাহেব মিটিংয়ে আছেন। মেজর জিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয়, ‘মেজর জিয়া সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া যাবে না’। সাবেক এই সেনাকর্মকর্তার দাবি হ"েছ- দৈনিক আমার দেশের এই সংবাদটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও মানহানিকর। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকা অফিস থেকে জানতে চাইলে সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘নিয়ম মোতাবেক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আনুষঙ্গিক দাপ্তরিক কার্য সম্পাদন অনে- অফিসিয়ালি যাবতীয় তথ্য জানানো হবে। মেজর জিয়া সংশ্লিষ্ট কর্মস'লে যোগদান না করায় তাঁর বির"দ্ধে সেনা আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে’। খেয়াল রাখতে হবে দৈনিক আমার দেশের বির"দ্ধে মামলা সেনা কর্তৃপক্ষ করছে না, করছে একজন সাবেক সেনা অফিসার। কিন' তিনি জানেন সেনা কর্তৃপক্ষ দৈনিক আমার দেশকে কী বলেছে। এখন অভিযোগ হ"েছ যে- বিবাদিরা তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে আমার দেশ তা উল্লেখ করায় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন এবং এতে বাদি একজন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা হওয়ায় তার মর্যাদা/সম্মানহানি হয়েছে।
সেনা সদরের তরফে যে সংবাদ সম্মেলন হয় সেখানে দৈনিক আমার দেশের বির"দ্ধে এই মামলার প্রসঙ্গ ওঠে নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে ৩ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে দৈনিক আমার দেশের প্রতিবেদনটিকে ‘হলুদ সাংবাদিকতার অংশ’ হিশাবে অভিযুক্ত করা হয়। দৈনিক আমার দেশ অবশ্য তার পরদিনই এই অভিযোগের জবাব দেয়। এরপর সেনা সদর থেকে কোন উত্তর এসেছে বলে আমি দেখি নি।
এই তথ্যগুলো পাঠকদের আবার বলবার কারণ হ"েছ- সেনাবাহিনীর তরফে যারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন তারা নাগরিকদের উৎকণ্ঠার মূল জায়গা এবং সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের মৌলিক প্রশ্নগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পুরা ব্যাপারটিকেই ‘প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের ইন্ধনে অবসরপ্রাপ্ত এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা কর্তৃক অন্যান্যদের ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিশঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার একটি বিফল প্রয়াস’ হিশাবে হাজির করেছেন। পুরা ব্যাপারটি আরো প্রশ্নবোধক হয়ে পড়েছে ইকোনমিস্টকে দেওয়া সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টায় অভিযুক্ত বেসামরিক ব্যক্তি প্রবাসী ইশরাক আহমেদের সাক্ষাৎকারে। ইশরাক আহমেদ ইকোনমিস্টকে বলেছেন- তিনি ধর্মান্ধ মৌলবাদী নন। ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দায়িত্বের সঙ্গে নিজের দেশকে স্বাধীন করতে তিনি লড়েছেন। তার বাড়ি থেকে মদ, ব্র্যান্ডি ও হুইস্কি জব্দ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অস্ত্র নয়। ইকোনমিস্ট বলছে- ইশরাক অনেক কথাই বলেছেন। তবে খুবই সম্ভব ও সুনির্দিষ্ট যে তথ্য তিনি জানিয়েছেন সেটা হোল- ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'া রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের সদস্যরা বাংলাদেশে তৎপর। এই সংস'ার সদস্যরা প্রায় দুই বছর থেকে বাংলাদেশী গোয়েন্দা সংস'ার কার্যালয়ে অফিস করছে এবং সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগব্যবস'াও কার্যকর রয়েছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক নজরদারি চালায় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর থেকে তাদের সন্দেহভাজনদের অপহরণ করে। ইশরাক আহমেদ আরো বলেছেন, সরকার সেনা অভ্যুত্থানের কথা বললেও কোনো ট্রুপস ও গান মুভমেন্ট দেখাতে পারে নি।
ইকোনমিস্ট এই সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে জানান দিতে চেয়েছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ সেনা সদর তুলেছে এবং ভারতের আনন্দবাজারের মতো পত্রিকা রটনা করে যা"েছ তার ভিত্তি দুর্বল। এই দিকটা প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে। আসলে কী ঘটেছে তা প্রকাশ ও প্রমাণের দায় সরকারের। আমরা আশা করব সেনাবাহিনী দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না। আমরা চাই বা না চাই এটা পরিষ্কার যে বাস-ব কারণেই দিল্লির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরোধিতা বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান নির্ণায়ক হয়ে উঠতে বাধ্য। এর জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ভারত নীতিই দায়ী। মৌলবাদ বা ধর্মান্ধ জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
৩০ জানুয়ারি ২০১২। ১৭ মাঘ ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com 
( লেখার তৃতীয় কিস্তি পড়-ন আগামী বৃহস্পতিবার)