শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

হিলারি কিনটনের স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ

হিলারি কিনটনের স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ


॥ ফরহাদ মজহার ॥

১.
হিলারি কিনটন শুধু বাংলাদেশে আসছেন না। প্রথমত তিনি আসছেন চিন থেকে। তারপর তিনি আসবেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে যাবেন ভারতে। কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন। তাঁর বাংলাদেশ সফরকে দিল্লী-ঢাকা-ওয়াশিংটন মিলে চিনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার সফর হিশাবে দেখতে চাইছেন অনেকে। এটা খুবই সরল ভাবে দেখা। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং ভাঙন বেসামাল হয়ে পড়ছে প্রায়ই। এর কারণে শক্তিশালী দেশগুলোর সামরিক ও নিরাপত্তা ভাবনা নতুন বাস্তবতায় বদলাচ্ছে। এর রূপ ঠিক কী দাঁড়াবে সেটা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাও আগের মতো তীব্র নয় এবং এই বৈরিতা চিরস্থায়ী হবে সেটাও আগাম অনুমান করা অসম্ভব। এটা ঠিক যে নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ টিকিয়ে রাখবার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। সন্দেহ নাই, সেই ক্ষেত্রে চিনকে সামাল দেওয়ার একটা চিন্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারতের আছে। শুধু এই দিকে নজর নিবদ্ধ রাখলে মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কের নীতিগত ও কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটছে কিনা সেটা আমরা ধরতে পারব না। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন একতরফা ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছেড়ে দেবে, এটা ভাবাও ঠিক নয়। ফলে এই তিনটি দেশের স্বার্থের ঐক্য এবং বিরোধ দুটো দিকই নজরে রাখা দরকার।
যারা বলছেন, এই সময়ে হিলারি কিনটনের বাংলাদেশে আসা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেবারই নামান্তর, তারা খুব ভুল বলছেন না। বিশেষত এর আগে না আসবার কথা বলে এবং এই বিশেষ অস্থির রাজনৈতিক সময়টা বাংলাদেশে আসার জন্য বেছে নিয়ে হিলারি কিনটন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবাদে সমর্থনই জোগালেন। অথচ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরেও বেগম খালেদা জিয়া বিদেশি মেহমানদের সম্মানে কোন কঠোর কর্মসূচি দিলেন না। তার সঙ্গে হিলারি কিনটন সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাত যেন বেসামাল না হয় সেই ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন অবশ্যই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক উত্থান পতনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়। বিদেশি শক্তিগুলো এই কারণেই রাজনৈতিক সংঘাত সীমা ছাড়িয়ে গেলে বিচলিত হয়। অন্যদিকে দুই পক্ষের এই সংঘাতের সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা গুণগত স্তরে উন্নীত করার চেষ্টাও করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখা যাক কী দাঁড়ায়।

২.
চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। পারমাণবিক শক্তি ও অস্ত্রের ক্ষমতাসম্পন্ন ভারত, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্্েরর মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্পর্ক পুরামাত্রায় বহাল রয়েছে। এগুলো জানা জিনিস। কিন্তু সামরিক শক্তির অবস্থা ও ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটছে সেইসবও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। যেমন : নৌ বাহিনীর শক্তি বা সমুদ্রের ওপর দখলদারি ও সামরিক আধিপত্য বজায় রাখবার শক্তি। সামরিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য দিকও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। হিলারি কিনটনের এই সফরের মাত্র কিছুদিন আগে ভারত দূর পাল্লার পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বালিস্টিক মিসাইল অগ্নি-৫ সফল ভাবে পরীক্ষা করেছে। নিজের সামরিক ক্ষমতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম সেটা দিল্লী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন উভয়কেই জানান দিল। সুস্পষ্ট ভাবেই সেটা প্রদর্শন করা হোল। এটা হোল হিলারি সফরে আসার আগে এক ধরনের সরব ঘোষণার মতো। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারত বেইজিং ও সাংহাইয়ে পারমাণবিক আক্রমণ চালাতে সক্ষম। যে অল্প কয়েকটি দেশ দূর পাল্লার পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম ভারত এখন তাদের কাবে যোগ দিল। দেশগুলো হচ্ছে চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিবারের সদস্য হোল এখন ভারত। ফলে সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্ন সরল ভাবে আলোচনার বিষয় নয়। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের সম্পর্কের জটিলতাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করাই সুবুদ্ধির লক্ষণ। 
চিনে মার্কিন রাষ্ট্রবিষয়ক সেক্রেটারির সঙ্গে থাকবেন তাদের ট্রেজারি সেক্রেটারি টিমথি গ্রেইথনার। তারা এখন সভা করছে উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়াং কিশান এবং রাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা দাই বিনগগু-ওর সঙ্গে। এটা চিন-মার্কিন চতুর্থ সামরিক কৌশল ও অর্থনৈতিক বিষয়ে চতুর্থ দফা পরামর্শ সভা (US- chi na strategic and Economic Dialogue (s & ED)। এই সভা দুই দেশের জন্য যোগাযোগ বাড়ানো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন এবারের সভার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দুই দেশের ‘পুরা সরকার’ (whole of government) এই সভায় অংশগ্রহণ করবে। মন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির প্রতিনিধিরা এখানে থাকবেন। হিলারি আরেকটি খুব উঁচু পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগ দেবেন চিনাদের সঙ্গে। সেটা হচ্ছে ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ’ বাড়াবার পরামর্শ সভা। মার্কিন আর চিনা নাগরিকদের মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা, খেলাধুলা, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল এবং নারী প্রসঙ্গ নিয়ে আরও বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ বাড়াবার পরামর্শ ও পরিকল্পনার জন্য এই সভা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুলান্ড এটাও জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ‘জবরদস্ত’ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিাত চুক্তিও হিলারি ঢাকায় পর্যালোচনা করবেন। তবে সেটা চূড়ান্ত কোন চুক্তিতে পৌঁছাবে কিনা তা জানান নি।
পশ্চিম বাংলার কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন হিলারি। মমতা ক্ষমতায় আসার পর কী উন্নতি ঘটল তার খোঁজখবর নেবেন বলে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া ওবামা প্রশাসনের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর দিয়েছে। 
বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছে তাতে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ছাড়া আরো অনেক সুবিধা তৈরী হয়েছে। মমতা কিভাবে সেইসব কাজে লাগাবেন সেটা সম্ভবত শুনতে চাইবেন হিলারি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বরাত দিয়ে যেসব খবরাখবর শোনা যাচ্ছে তাতে এই ধরনের অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া বিশেষ কিছু এখনো জানা যায় নি। মমতা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কী সুযোগ নিতে চান বা চাইবেন সেটা হিলারি কিনটন জানতে চাইতেই পারেন এবং সেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সাধারণ স্বার্থ নিহিত আছে কিনা সেটা জানা এবং মমতা ব্যানার্জিকে বোঝা তার কাজ। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজ্য হিশাবে পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক এবং সে গতিকে আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়েও মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলবেন হিলারি, এটা স্বাভাবিক। তবু বলা যায়, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক নিয়ে হিলারি-মমতা কথা বলবেন এই রটনা মনে হয় গৌণ। মমতা ভারতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আগামি দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন তিনি। ফলে তার সম্পর্কে এখন থেকেই মার্কিনীদের সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরী একটা কাজ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান প্রতিনিধির এটাই আসল কাজ। 
চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের সভা করে এসে বাংলাদেশে হিলারি কিনটন চিনের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে নতুন এক প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে আসবেন এটা চিন্তা করতে অনেক বেশি কল্পনা শক্তির দরকার হয়। বিপজ্জনক হোল নতুন করে বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীনে আনবার প্রয়োজনীয়তা যে নাই এই দিকটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। ভুলছি কারণ শেখ হাসিনা ও মনমোহনের দিল্লী ঘোষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে করিডোর দেবার চুক্তির মর্ম বুঝবার অক্ষমতা। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেইমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট মূলত একটি সামরিক ও নিরাপত্তামূলক চুক্তি। এই চুক্তির পর এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবার পর শেখ হাসিনার সরকারকে নতুন করে মার্কিন-ভারত ও ইসরায়েলের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের পাহারাদার প্রমাণ করা অপ্রয়োজনীয়। এই বিষয়ে আমি এর আগে লিখেছি। (যেমন ‘ভারতের নিরাপত্তা বন্দোবস্ত ও হাসিনা-মনমোহন চুক্তির সামরিক লক্ষ্য’ (নয়া দিগন্ত ৯-১০-২০১০;) “দিল্লীর সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের গোলামি বাংলাদেশের ‘নিয়তি’ হতে পারে না”...ইত্যাদি)। এখানে সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করব না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঠিক কী চুক্তি হয় তা দেখার জন্য আমরা বরং অপেক্ষা করব। তখন নতুন কী যোগ হোল তার বিচার করা যাবে। এখানে হিলারি কিনটন মার্কিন কূটনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কিভাবে আনতে চাইছেন ও আনছেন সেই সম্পর্কে তারই একটি লেখা ধরে দুই একটি কথা বলব।
৩.
হিলারি কিনটনের যে লেখাটির কথা বলছি সেটা ছাপা হয়েছিল Foreign Affairs (November December 2010) পত্রিকায় লেখাটির শিরোনাম, ‘বেসামরিক শক্তির জোরে নেতৃত্ব রাখা : মার্কিন কূটনীতি ও উন্নয়ন কৌশলের পুনর্বিবেচনা’ (Leading Through Civilian power : Redefining Amercan diplomacy and Development)। হিলারি বলছেন, এই কালে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (সাম্রাজ্যবাদী) নেতৃত্ব বহাল রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্মার্ট বা চৌকস হতে হবে। এর নাম তিনি দিয়েছেন ‘স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ’। বিশ্বের সংকটকে তিনি সাজিয়েছেন সন্ত্রাস-বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা-জলবায়ুর পরিবর্তন এবং দারিদ্র-এই ভাবে পরপর। বিশ্বে ক্ষমতা আর এক কেন্দ্রিক নয়, ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এই পরিস্থিতি সকলকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সেটা কঠিন কাজ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক শক্তিকে সংগঠিত করতে হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি রবার্ট গেইটস যেভাবে বলেছেন হিলারি কিনটনও তাকে সমর্থন করেই বলেছেন বেসামরিক শক্তির সঙ্গে সামরিক শক্তির সঙ্গে আরো ভাল সমন্বয় ঘটাতে হবে। মার্কিন বেসামরিক সংস্থা যেমন পররাষ্ট্র দফতর ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (United States Agency for International Development সংক্ষেপে USAID) প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদেরকে আরো নেতৃত্ব দেবার ভূমিকায় নিয়ে আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ায় তার সম্রাজ্যবাদী নেতৃত্ব বজায় রাখতে হলে শুধু সামরিক শক্তির নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র দফতরের কূটনীতি ও মার্কিন সাহায্য সংস্থাকেও যার যার ক্ষেত্রে নেতৃত্বদান কারী ভূমিকা পালন করতে হবে। তার মানে সমরনীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতি এই তিন ক্ষেত্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোকেও সমান তালে সমান মাত্রায় নেতৃত্ব দিতে হবে। এর জন্য লোকবল ও অর্থবল বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ইউএসএইডকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নতুন করে সাজাবার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এটি পৃথিবীর সেরা উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়। এর জন্য মার্কিন লোকজন নিয়োগ করা ছাড়াও বিভিন্ন দেশে স্থানীয় ভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যেন মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় তার ওপর হিলারি জোর দিয়েছেন। নিজের দেশের সম্পর্কে তাদেরই গভীর জ্ঞান আছে। উদাহরণ হিশাবে বলা যায়, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে যারা মার্কিন দূতাবাস কিম্বা মার্কিন সাহায্য সংস্থায় কাজ করবে তাদেরকে আরও ভাল ভাবে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। তারাই বাংলাদেশকে ভাল চেনে ও জানে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বহাল রাখবার জন্য এটা হচ্ছে স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ। এটা নতুন জিনিস।
এই এপ্রোচ মনে রেখে হিলারি কিনটন ২০০৯ সালের দিকে পররাষ্ট্র দফতর ও মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার আমূল সংস্কার ও কাজ করবার ধরনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন এবং সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কাজের ধরনে যে পরিবর্তন ঘটেছে সংক্ষেপে তার কয়েকটি দিক তুলে ধরছি যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এক. কূটনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন তৎপরতাকে কাজ করতে হবে সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি এবং সামরিক তৎপরতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে।
দুই. কূটনীতি এতোকাল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চর্চা হোত। কিন্তু এখন সেটা আর হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ ও উন্নয়ন সংস্থা একটি দেশের সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিভাগ ছাড়াও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দল, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন ও মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবেন।
মার্কিন দূতাবাস ও মার্কিন দূতের ভূমিকা এই কাজ করবার জন্য দক্ষ হতে হবে এবং কূটনীতির পুরানা ধ্যানধারণা বাদ দিতে হবে। নিজেদেরকেও বদলাতে হবে।
তিন. দুনিয়া জুড়ে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে তার কারণে সরকারের বাইরে নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেসব ইস্যু আগে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে মনে করা হোত এখন তাকে সেভাবে দেখলে চলবে না। যেমন অর্থনৈতিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও নীতি, ওষুধ ও অসুখ, সংগঠিত অপরাধ, ুধা ইত্যাদি। স্বাস্থ্য কৃষি গরিবী মোচনের মতো কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
চার. সরাসরি একটি দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে এই কারণে যে যারা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে সক্রিয় (non state actor), বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনগণকে আগের চেয়ে তারা আরও অনেক দ্রুত গতিতে প্রভাবিত করতে সক্ষম। হিলারি কিনটন নন স্টেইট এক্টর বলতে মূলত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াকু রাজনৈতিক গোষ্ঠি যেমন মাওবাদি বা সশস্ত্র বামপন্থি দল এবং মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইসলামপন্থি দল বা শক্তির কথাই বলছেন। যেসব বামপন্থি মানব বন্ধনের মতো কর্মসূচী দিয়ে বিপ্লবের দায় সারছেন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কোন হুমকি নয়। তারা সুশীল সমাজেরই অংশ, সেই হিশাবে মিত্র।
পাঁচ. হিলারি পরিষ্কারই বলছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ‘সুশীল সমাজ’ তৈরি ও তাদের বিস্তার ঘটানোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করবার সঠিক নিরাপত্তা কৌশল।
বলা বাহুল্য, মার্কিন সামরিক নীতির সাথে কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতির সমন্বয় ঘটাবার মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে হিলারি কিনটন দেশে দেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন তার আরও বিশ্লেষণ দরকার এবং বাংলাদেশে তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার ওপর নজরদারি নিবদ্ধ রাখা খুবই জরুরি। আজ তার সুযোগ হবে না।
এতটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে বাংলাদেশে হিলারি কিনটনের সফরের অর্থ বোঝার জন্য শুধু সরকারি পর্যায়ে কী চুক্তি হতে যাচ্ছে সেই দিকে নজর রাখলে চলছে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কূটনীতির চর্চার নীতি পরিহার করেছে সেটা তো তারা লিখেই জানান দিচ্ছে সারা দুনিয়ায়। এটা গোপন কিছু নয়।
শেখ হাসিনা বা বেগম খালেদার সাথে সাক্ষাতেরও তাৎপর্যও এই পরিপ্রেক্ষিতে গৌন। বরং বাংলাদেশে হিলারি যে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সাথে দেখা করবেন সেটাই হবে তার সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। সেটা দেখা ও বোঝার অপেক্ষায় রইলাম। 
farhadmazhar@hotmail.com
৪ মে ২০১২। ২৫ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

মানবাধিকার ও হরতাল বিরোধিতার রাজনীতি



২০১২-০৪-২৬

১. 
মানুষকে ‘গুম’ করে ফেলার অপরাধ মানবাধিকারের চরম লংঘন। রাষ্ট্র নাগরিকদের রক্ষা করবার কথা, কিন্তু রাষ্ট্রই নাগরিকদের ‘গুম’ করে ফেলছে। যে ‘গুম’ হয়ে যাচ্ছে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না, কিম্বা কিছু দিন পর তার লাশ আবিষ্কৃত হচ্ছে। এই অপরাধের বিরুদ্ধে বিএনপির ডাকা হরতালের ইতিবাচক দিক হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার লড়াই জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে পরিণত হবার সম্ভাবনা এই প্রথম বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। হরতাল বা কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে যেভাবে চতুর্দিকে প্রচার চলছে সেই প্রচারের রাজনৈতিক চরিত্র বোঝা এখন একটা জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
‘গুম’ হয়ে যাওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনসারকে সরকার এখনও উদ্ধার করতে সক্ষম হয় নি। প্রকাশ্যে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির তিন দিনের হরতালও সাময়িক শেষ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনসারকে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য সরকারকে আগামি ২৮ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে মানুষ পুড়ে মরেছে, পুলিশের গুলিতে বিশ্বনাথে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কতজন তার হিশাব নাই। তা ছাড়া হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এই দুর্ভোগ সাধারণ মানুষকে পোহাতে হবে। সরকারকে যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেই সময়সীমার মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারকে যদি পাওয়া না যায় তাহলে এরপর কী ঘটবে তা এখনই আন্দাজ করা কঠিন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন ঘটবার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কারণ ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরেও সমাজে রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে গুণগত পরিবর্তনের বিশেষ কোন লক্ষণ আমরা দেখছি না। রাষ্ট্রের যে গভীর অসুখ আমরা দেখছি তা নিরাময়ের পথ কী হতে পারে তা নিয়ে সমাজে বিশেষ কোন ভাবনাচিন্তা নাই। বরং হরতালের বিরোধিতাই দেখছি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হরতাল বা কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরোধিতা করার অর্থ তাহলে আমাদের বিচার করে দেখা দরকার।
ঠিক যে মানবাধিকার রক্ষার লড়াই জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে পরিণত হবে কি না সেটা আমরা বাংলাদেশের আগামি দিনগুলোতে দেখব। আমরা সম্ভাবনার কথা বলছি কেবল। এই লড়াইকে বিকশিত করা এবং তাতে নেতৃত্ব দেবার শক্তি ও যোগ্যতা আমরা অর্জন করেছিÑ এই দাবি করা যাবে না বলেই শুধু সম্ভাবনার কথা বলা। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা দূরের কথা, মানবাধিকারের সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্পর্ক কী এবং কেন মানবাধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গাঠনিক ভিত্তি সেই দিকগুলো আমাদের কাছে এখনো পরিচ্ছন্ন নয়। তবুও সম্ভাবনা দেখছি কেন? দেখছি এ কারণে যে এই সম্পর্ক বিচার নিছকই তত্ত্বগত ব্যাপার নয়, একটি দেশের জনগণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই এই শিক্ষাটা অর্জন করতে পারে। রাজনৈতিক কর্মসূচির গুরুত্ব এখানেই। যদি মানবাধিকার ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচার আমাদের জাতীয় রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে তাহলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক চর্চার গুণগত রূপান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। 
যে সহজ সূত্র মনে রেখে আমরা আলোচনা করতে পারি তা হচ্ছে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি এবং তা রক্ষা করবার কর্তব্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি। গণতন্ত্র সম্পর্কে এই অতি প্রাথমিক পাঠ আমাদের বিশেষ নাই বললেই চলে। গণতন্ত্র বলতে আমরা নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু বুঝি কি না সন্দেহ। বাংলাদেশে গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক দল ও শক্তি এই কারণে সাংবিধানিক ভাবে একনায়কতন্ত্র ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বহাল রেখে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের ওপর একনায়কী শাসন কায়েম করে রাখতে পারছে। কখনো সেনাপতিরা সামরিক কায়দায় আবার কখনো রাজনীতিবিদরা বেসামরিক কায়দায় গণতন্ত্রের আলখেল্লা গায়ে দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালিয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ফ্যাসিবাদের মধুর স্বাদও তারা আমাদের দিয়েছেন। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েমকেও আমরা এখন ‘গণতন্ত্র’ বলে থাকি। বাংলাদেশে কি এখন ‘গণতন্ত্র’ কায়েম নাই? আছে। কারণ আমরা ভোট দিয়েই তো সরকার গঠন করেছি। ধন্য দেশ!
তবুও আশা কেন? আশা এ কারণে যে আজ না হয় ইলিয়াস আলীর জন্য হরতাল ডাকা হয়েছে, কাল আমরা আজ অবধি যত মানুষ ‘গুম’ হয়েছে, তাদের সকলের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেও পারি। অন্তত বোধ করবার আশা করতে পারি। মানবাধিকারবিরোধী সব শ্রেণী ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার রাজনৈতিক তাগিদ হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে শিখব। কিন্তু সেটা শিখব মানবাধিকার কর্মী হিশাবে নয়, রাজনৈতিক কর্মী হিশাবে। আর আশাটা ঠিক এখানেই।
রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি ও রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তি নাগরিক হয়ে ওঠে। এই ভিত্তির ওপর রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে গঠন করবার লড়াই হচ্ছে বাংলাদেশের এখনকার লড়াই। এটাই এখন গণতান্ত্রিক জনগণের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। এই রাজনৈতিক উপলব্ধি সঞ্চার খুব সহজ কাজ নয়। অথচ একটু খোলা মনে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব বাংলাদেশে আমরা যে রাষ্ট্রের অধীনে বাস করি সেই রাষ্ট্রে আমরা দাস, নাগরিক নেই। যে কোন নাগরিক এই রাষ্ট্রে ‘গুম’ হয়ে যেতে পারে। ‘গুম’ তো হয়ে যাচ্ছে। নাগরিকদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র বা সরকার চলে না, সেভাবে এই রাষ্ট্র বানানো হয় নি। চলে কতিপয় মাস্তান বা মাফিয়া গোছের সংগঠনের হুকুমে। অথচ তাদের আমরা রাজনৈতিক দল নামে অভিহিত করে আনন্দ বোধ করি। যখন কিছু দুর্বৃত্তের চরিত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে তখন আমরা হৈচৈ শুরু করি। কিন্তু করি আরেক দঙ্গল দুর্বৃত্তকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করবার জন্য। তারপর যখন দেখি যাহা বাহান্ন তাহাই তেপান্ন, তখন বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি। তখন আবার নিজেকে নীতিনিষ্ঠ প্রমাণ করবার জন্য ঘোরতর ভাবে রাজনীতিবিরোধী হয়ে যাই। এখানেই শেষ না। অতঃপর রাজনীতি মাত্রই খারাপ এই গীত গেয়ে অন্যদেরও রাজনীতিবিমুখ করবার তৎপরতায় নেমে পড়ি। এই যখন আমাদের দুর্দশা তখন একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিন হরতাল পালন করা হয়েছে। সেটা কম কথা নয়। এটা তাৎপর্যপূর্ণ।

২.
তবে বিএনপি মানবাধিকার মর্যাদা বুঝে হরতাল ডেকেছে কি না সেটা বিএনপিকেই বোঝাতে হবে। সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের সকল ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নাগরিকদের পক্ষে এই হরতাল নয়, কিম্বা সাধারণ ভাবে ‘গুম’ বা সর্বপ্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধেও এই হরতাল ডাকা হয় নি। ডাকা হয়েছে বিএনপিরই একজন নেতা ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনসারের জন্য। তবে অন্তত বিএনপি তার অন্যান্য দলীয় রাজনৈতিক ইস্যুর চাইতেও ‘গুম’ হবার কারণে হরতাল ডেকে মানবাধিকারকে রাজনৈতিক ভাবে তুলে ধরবার শর্ত তৈরি করেছে।
তবুও ইলিয়াস আলী ও আনসারের জন্য হরতাল ডাকার পক্ষে একদমই যুক্তি নাই, বলা যাবে না। একটি আশার ওপর সেই যুক্তি দাঁড়াতে পারে। এর আগে যারা ‘গুম’ হয়েছে তাদের হয়তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না, কিন্তু আশা আছে যে ইলিয়াস আলী এখনো জীবিত রয়েছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক অবশ্য জোর দিয়েই বলেছেন, তিনি নিশ্চিত যে ইলিয়াস আলী জীবিত। আইনজীবী হিশাবে তিনি সরকারের আরেকটি তৎপরতায় প্রচণ্ড ুব্ধ হয়েছেন। সেটা হোল ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে দশ বছর পুরানা অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা। একটি লোক গুম হয়েছে পুলিশ জানে, কিন্তু এই মামলা গ্রহণ করা হোল কেন? এই সূত্র ধরেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটা ‘গুম’, নিখোঁজ নয়। কারণ এই নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। সরকার জানে, অথচ অস্বীকার করছে। ‘গুম’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশান অনুযায়ী এটা ‘গুম’ হবার ঘটনা। নিখোঁজ বা অন্তর্ধান নয়। ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাদের নামে এই হরতালের যৌক্তিকতা তাহলে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ঠিক যে মানবাধিকার বিএনপির হাতেও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বারবার। আইনবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে বিএনপির খ্যাতি আছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নাই, বরং র‌্যাব গঠন করেছে বলে গর্ব আছে। এই সকল কারণে জনগণের বড় একটি অংশ ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হওয়ায় বিুব্ধ হলেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হরতালে অংশগ্রহণ করে নি বলে মনে হয়েছে। তবুও নিজ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার জন্য বিএনপি হরতালের কর্মসূচি দিলেও, যেহেতু এই কর্মসূচি ‘গুম’ হয়ে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছে, এই হরতালের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিএনপির দলের সংকীর্ণ উদ্দেশ্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
অতএব মানবাধিকারের মর্যাদা রক্ষার জায়গা থেকে এই হরতালকে সমর্থন না করবার কোনো রাজনৈতিক বা মানবিক যুক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু শুরু থেকেই এই হরতালের বিরুদ্ধে একটা প্রবল বিরোধিতা আমরা লক্ষ্য করেছি। ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার কথা আলাদা। বিরোধিতা করেছে সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ। বিরোধিতা করেছে সরকার সমর্থিত ও সংগঠিত ব্যবসায়ী শ্রেণি। বোঝা যাচ্ছে এই সরকারের বিরুদ্ধে কোন কঠোর কর্মসূচি তারা চায় না। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ব্যাপারটা তাদের কাছে বিএনপির একজন রাজনৈতিক নেতার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপার মাত্র। অন্য দিকে এমন অনেকেই আছেন যারা নীতিগত ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনবিরোধী তাদের বড় একটি অংশ এই হরতাল সমর্থন করে নি। তাদের বিরোধিতার যুক্তি হচ্ছে এই হরতাল বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন আঠারো দল ডেকেছে, অতএব এ হরতাল সমর্থন করা মানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থন করা। সম্ভবত তারা একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির দলীয় উদ্দেশ্য আর বিশেষ পরিস্থিতিতে কর্মসূচির রাজনৈতিক তাৎপর্যের মধ্যে পার্থক্য করছে না। আমরা এই কারণে তাদের সঙ্গে একমত নই। কিন্তু হরতালের বিরোধিতা করে যারা প্রকারান্তরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তাদের সঙ্গে এদের যেন আমরা একাকার না করে ফেলি।

৩.
বিএনপি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে তখন বিএনপির উদ্দেশ্য একান্তই দলীয়। বিএনপি আগে এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক সেটাই চায়, কারণ তা না হলে নির্বাচনে কারচুপির এবং হেরে যাবার আশঙ্কা আছে তাদের। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করবেন কারণ তা না হলে নির্বাচনে তার অসুবিধা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই পক্ষের কাছেই নির্বাচনী কৌশল মাত্র, তত্ত্বাবধায়ক তর্ক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার বা মৌলিক গাঠনিক কোন তর্কের বিষয় নয়। সেই ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের কর্মসূচি সমর্থন করা দলীয় সমর্থনই বটে। কিন্তু কারো ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনার প্রতিবাদের কর্মসূচির চরিত্র ভিন্ন। বিশেষত যখন ‘গুম’ হওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে, তখন তা রাষ্ট্রের গুরুতর সঙ্কটের দিকে আমাদের নজর নিবদ্ধ করে। নিজের দলের কর্মীর ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপির দলীয় কর্মসূচিও তখন রাষ্ট্রের গাঠনিক চরিত্র নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এটা পরিষ্কার যে ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নিছক ফৌজদারি অপরাধের বিষয় নয়। রাষ্ট্রই এখানে অপরাধী। বিএনপি চাক বা না চাক ‘গুম’ হওয়ার বিরুদ্ধে যে কোন কর্মসূচি সমাজে রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করবার সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরী করে এবং তা দলীয় সংকীর্ণ উদ্দেশ্য ছাড়িয়ে যায়। কিম্বা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এবারের হরতালের বৈশিষ্ট্য হোল কোন ইসলামী দলকে হরতালে বিশেষ ভাবে তৎপর দেখা যায় নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার জন্য বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে ক্ষমতাসীনরা এই অভিযোগ করলেও তাদের গলায় জোর ছিল না। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য হরতাল হচ্ছে এই যুক্তিতে হরতালের বিরোধিতা করা কঠিন। মানবাধিকারের প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান থাকার পরেও বিএনপির ডাকা হরতালের পক্ষে থাকা না থাকা নিয়ে যারা দোদুল্যমানতা দেখিয়েছেন তাদের কথা আগে বলেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য এই হরতাল এই যুক্তি তাদেরও থাকতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এর কোন ভিত্তি নাই। এই পরিস্থিতিতে হরতাল প্রশ্নে অবস্থানহীনতা রাজনীতিহীনতারই সমার্থক। এতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম এগিয়ে যাবে না, বরং পিছিয়ে পড়বে।
অবস্থান নেবার মানে এই নয় যে বিএনপির পাশাপাশি হরতালের কর্মসূচি দিতে হবে। মোটেও না। হরতালে অংশগ্রহণের কথাও বলছি না। বরং বলছি এই বিশেষ ইস্যুতে হরতালের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। যত নির্বাক বা আড়ালেই থাকি না কোন কোন ইস্যুতে আমরা কী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি তা সমাজের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার নির্ণায়কও বটে। সেই কারণে কথাগুলো বলে রাখা দরকার।

৪.
কিন্তু নানা অজুহাতে যারা হরতালের বিরোধিতা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে তারা আসলে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট শক্তি ও মানবিক অধিকারবিরোধী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখবার জন্যই হরতালের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কর্মসূচির আগে থেকেই প্রচার চালিয়ে আসছে তারা এবং এখনো প্রচার চালাচ্ছে। এই প্রচার আরো জোরেশোরেই চলবে। তারা সচেতন ভাবেই অর্থনৈতিক দুর্ভোগের কথা বলে ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দমন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নিরন্তর মতাদর্শিক বয়ান ও যুক্তি তৈরি করছে। এটাই এবারের হরতালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিক। হরতাল চাই না, হরতাল ভালো না, হরতাল খারাপÑ এই কেচ্ছা অনবরত শুনতে হচ্ছে আমাদের। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান দুষমন হিশাবে এই ধারার তৎপরতা হরতালের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে খুব স্পষ্ট ভাবেই ফুটে উঠছে।

‘গুম’ করছে রাষ্ট্র তার পরেও এবারের হরতালের বিপক্ষে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তি যেসব যুক্তি হাজির করছে সেটাই বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন উপাদান। বিএনপি ও তার অধীনে জোটভুক্ত দলের রাজনীতির বিরোধিতা দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদের সমর্থক শ্রেণি ও শক্তিকে এখন চিনব না। ক্ষমতাসীন মহাজোটকে প্রকাশ্যে তারা সমর্থনও করতে পারছে না। গত কয়েক বছরে তাদের শাসনের যে নমুনা দেখেছে মানুষ তার জন্য ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়ানো মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিরোধী শ্রেণি ও শক্তিগুলোর পক্ষে এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার পথ কী? ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে যে কোন কঠিন কর্মসূচিÑ বিশেষত হরতালের বিরোধিতা করা। ফ্যাসিবাদের পক্ষের শ্রেণি ও শক্তি ঠিক এই পথটাই বেছে নিয়েছে। তারা হরতালের প্রাণপণ বিরোধিতা করছে। ফ্যাসিবাদের পক্ষের শ্রেণি ও শক্তিকে এখন তাহলে চিনতে হবে তাদের অতিরিক্ত হরতাল বিরোধিতার মধ্যে।
হরতালের বিরোধিতার যুক্তির অভাব নাই। তিন দিনের হরতালে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত চারজন। সহিংসতা ঘটেছে, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, জনগণকে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এই সময়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাগুলো স্থগিত করতে হয়েছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কাস ও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরপর তিন দিনের হরতালে ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। এসব অভিযোগ সত্য কোন সন্দেহ নাই। তাহলে তো সামরিক শাসক এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ লড়াই সংগ্রাম করে জান ও মালের যে অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়েছিল তা খুবই ভুল কাজ ছিল। এরশাদ ছিল সামরিক সৈরশাসক, তার কোন গণসমর্থন ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে এখন লড়তে হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, শুধু সরকারও নয় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। স্বৈরশাসনের সাথে তার মৌলিক তফাত হচ্ছে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিপুল গণসমর্থন থাকে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শ্রেণি ও শক্তির জন্য এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

ফ্যাসিবাদের পক্ষে দ্বিতীয় যে যুক্তি দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বার্থের যুক্তি। বলা হচ্ছে হরতালে নাগরিকদের নিজেদের এবং সামগ্রিক ভাবে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষতি হচ্ছে। অতএব, রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম করা যাবে না। মানবিক অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাক্সা এবং তার পক্ষে রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের বিপরীতে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থকে বারবার মুখ্য করে তোলা হচ্ছে। তুলবে। মানুষের ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষার কথা বলে তার সামষ্টিক রাজনৈতিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার তুমুল প্রচারণা চলছে। পত্রপত্রিকায় টেলিভিশানে মানুষ কিভাবে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই দিকটাকেই প্রচারের মুখ্য বিষয়ে পরিণত করা হচ্ছে। হরতাল যে কতো খারাপ জিনিস তা প্রমাণের ধুম পড়ে গিয়েছে। যার নজির আমরা যে কোন পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশানে দেখতে পারব। 

প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের ক্ষতি হবে না বা হরতালে মানুষের দুর্গতি হচ্ছে না তা নয়। যে কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে ত্যাগ থাকে মানুষের। ব্যক্তিস্বার্থকে সমষ্টির স্বার্থের অধীনে নিয়ে আসার মধ্য দিয়েই রাজনীতি সমষ্টির স্বার্থ হয়ে ওঠে। সমাজে ব্যক্তি হিশাবে আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিরন্তর অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা চলে। সমাজে আমরা এক নই, অনেক। ব্যক্তির কাছে অন্য সব ব্যক্তি বা সমাজ নিজ নিজ ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের উপায় মাত্র। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আমরা ব্যক্তির স্বার্থ নয়, সমষ্টি স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করি। বলাবাহুল্য, দলবাজি নিয়ে কথা বলছি না আমরা। দলবাজিকে যেন আমরা রাজনীতি বলে ভুল না করি। সমাজে ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যক্তি আলাদা, পৃথক, অসম, বিভিন্ন, বিচিত্র ইত্যাদি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আমরা ‘এক’ হয়ে যাই বা সকলের রাজনৈতিক সত্তা সমান এই সত্য মানি ও তা উপলব্ধির চেষ্টা করি। বাংলাদেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে সমষ্টির মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করেছিলেন। ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার যে রাজনীতি সেই রাজনীতি শুধু আমার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করে না, নাগরিক হিশাবে সকলের অধিকার রক্ষা করে। রাজনীতি বা রাজনৈতিক সমাজ হচ্ছে সেই পরিমণ্ডল যেখানে সবার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করা সম্ভব। কিন্তু ফ্যাসিবাদ এখন এই সম্পর্ককেই উল্টিয়ে দিতে চাইছে। মানবাধিকার আদায় ও রক্ষার জন্য কঠোর কোন আন্দোলন-সংগ্রাম করা যাবে না। কোন হরতাল করা যাবে না। কারণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। ব্যক্তি স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থকে রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদ বিদ্যমান রাষ্ট্রকেই শুধু টিকিয়ে রাখতে চাইছে না, একই সাথে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও টিকিয়ে রাখতে চাইছে। ফ্যাসিবাদ বলতে চায়, রাজনৈতিক মুক্তির দরকার নাই, তার জন্য লড়াই-সংগ্রাম আত্মত্যাগ মূল্যহীন, অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষাই আমাদের প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সম্পর্ক উল্টিয়ে দেবার সাফল্যের মাত্রাই ফ্যাসিবাদের আগামি দিনে টিকে থাকা না থাকা নির্ণয় করবে। সামষ্টিক রাজনৈতিক স্বার্থকে অস্বীকার করবার জন্য ব্যক্তি স্বার্থকেই বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদ মহিমান্বিত করে তুলবে। ফ্যাসিবাদের পক্ষে প্রচারের এই ধরনই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। সবচেয়ে বিপজ্জনক। 

আইনবহির্ভূত হত্যা, মানুষ ‘গুম’ করে ফেলা ইত্যাদি অপরাধ বন্ধ করবার জন্য অনেকে রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি র‌্যাব বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিলুপ্ত করে দেবার প্রস্তাব দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা হিউমেন রাইটস ওয়াচ এই প্রস্তাব দিয়ে আসছে অনেক দিন আগে থেকেই। রাষ্ট্রের কোন সংস্থা দানব হয়ে উঠলে তাকে বিলুপ্ত করা একটা দাবি হতেই পারে, যে কোন অসুখের বাহ্যিক উপসর্গেরও বিধান দরকার। কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের গাঠনিক অসুখ সারবে না এটা নিশ্চিত বলা যায়। আরেকটি সংস্থা বানাবে বর্তমান মানবাধিকার বিরোধী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সেটাও অচিরে আবার দানব হয়ে উঠবে। সমাজে রাজনৈতিক চিন্তার গুণগত পরিবর্তনের লক্ষণ অসুখের বাহ্যিক চিকিৎসায় প্রস্তাবে নাই। নিদেনপক্ষে মানবাধিকার রক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের গাঠনিক সম্পর্ক নিয়ে যে ন্যূনতম উদ্বেগ সমাজে তৈরি হবার কথা, সমাজে তা অনুপস্থিত। ফলে বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতন, দৈহিক ভাবে আটক ব্যক্তিকে অমানুষিক ভাবে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, আইনবহির্ভূত হত্যা, ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ইত্যাদির হাত থেকে আমরা অচিরে নিস্তার পাব এমন আশা করা কঠিন। সঙ্ঘাত, রক্তপাত, দমন-পীড়নের অসহনীয় অত্যাচার তো আছেই। দলীয় মাস্তানির কুৎসিত বলয়ের মধ্যে আমাদের আরো কত দিন ঘুরপাক খেতে হবে কে জানে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একা দায়ী করে নিজেদের পাপ লাঘব করা সহজ। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে সমাজে চিন্তাচেতনার অনাগ্রহ এবং অভাবের দিকেও আমাদের নজর ফেরাতে হবে। এই অনাগ্রহ ও অভাবের কথা মনে রেখেই একটি মানবাধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে তিনদিনের হরতাল পালন ইতিবাচক। হরতালের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শ্রেণি ও শক্তির প্রচারণার জবাব দেওয়ার জন্য এই কথা জোরের সঙ্গে এখন বলা দরকার। 
ঠিক যে হরতালের কর্মসূচি বিএনপির। কিন্তু রাজনীতি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ব্যাপর মাত্র নয়। একদা একটি আদর্শ রাজনৈতিক দল আকাশ থেকে নেমে আসবে এবং সেই দল আমাদের মুক্তি দেবে, তারপর সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেÑ এই ধরনের আধ্যাত্মিক চিন্তায় মগ্ন থেকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক তৎপরতার প্রতি বিমুখ থাকা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশে খেটে খাওয়া শ্রেণির রাজনীতির দুর্বলতার কারণে এই প্রকার আধ্যাত্মিক প্রবণতা বেড়েছে। যদি আমরা রাজনীতি বা রাজনৈতিক তৎপরতার বিমুখ হয়ে পড়ি তাহলে ফেরেশতা এসেও আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না। রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা ক্ষতি ছাড়া কোন জনগোষ্ঠির জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে নি। আজ রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাধা হয়ে উঠেছে। এই আধ্যাত্মিকতার ধারকরা বিদ্যমান দুই রাজনৈতিক পক্ষের দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির নজির টেনে রাজনীতি থেকে জনগণকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ থেকে জনগণকে নিরুৎসাহিত করছে। 
আমাদের কাজ হচ্ছে জনগণকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করা। রাজনীতির কোন ইস্যু দলীয় স্বার্থ রক্ষা করে এবং কোন ইস্যু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে জড়িত নিদেনপক্ষে এই ভেদবুদ্ধির বিকাশ ঘটানোর প্রাথমিক কাজগুলো তো আমাদের সম্পন্ন করতে হবে। নয় কি? 
২৫ এপ্রিল ২০১২। ১২ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১২

‘গুম’ হয়ে যাওয়ার বিভীষিকা ও বাংলাদেশের বিপদ

স্বাধীন দেশে জননিরাপত্তাহীনতার বেহাল চিত্র


॥ ফরহাদ মজহার ॥ 

বিএনপির নেতা, সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী এখনো ‘গুম’ রয়েছেন। আজ ২৩ এপ্রিল তার জন্য বিএনপির দ্বিতীয় দিনের হরতাল চলছে। যদি ইলিয়াস ছাড়া না পান তাহলে এই হরতাল লাগাতার চালানো হবে বলে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে আরো অনেকে গুম হয়েছেন। তারা সাধারণ নাগরিক। মানবাধিকার কর্মীরা এর বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সোচ্চার ছিলেন। এতে ‘গুম’ হয়ে যাবার বিভীষিকা মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে। ইলিয়াস আলী একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতা। তিনি ‘গুম’ হয়েছেন বলে ‘গুম’ ব্যাপারটি এখন একটি দলীয় রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন তাঁর নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথে পুলিশ ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে দুইজন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন বলে সংবাদ পেয়েছি। বাংলাদেশ আবার দ্রুত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার দিকে এগিয়ে গেল।
মানবাধিকারের দিক থেকে নিখোঁজ হওয়া আর গুম হওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। ইলিয়াস আলীর পরিত্যক্ত গাড়ি বনানীতে পাবার পরপরই অভিযোগ উঠেছিল তিনি নিখোঁজ হন নি, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। সরকার যথারীতি অস্বীকার করেছে কিম্বা যেভাবে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে সরকারের অবগতির মধ্যেই ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযোগ। শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, বিএনপিই তাকে লুকিয়ে রেখেছে। তাঁর এই মন্তব্যে সরকারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আরো গাঢ় হয়েছে মাত্র। ফলে তিনি হারিয়ে যান নি বা নিখোঁজও নন। ‘গুম’ হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি ‘গুম’ হয়েছেন। এই চুক্তির নাম ‘গুম হওয়া থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি’ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়হাবহঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব চৎড়ঃবপঃরড়হ ড়ভ অষষ চবৎংড়হং ভৎড়স ঊহভড়ৎপবফ উরংধঢ়ঢ়বধৎধহপব)। ‘গুম’ মানে এখানে জবরদস্তি কাউকে নিখোঁজ করে ফেলাÑ ‘এনফোর্সড ডিঅ্যাপিয়ারেন্স’। এই চুক্তি অনুযায়ী ‘গুম’ হওয়া মানে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়া নয় কিংবা কোন অপরাধী বা অপরাধী চক্র অপহরণ করলে এবং কাউকে খুঁজে না পেলে সেটাও এই কনভেনশান অনুযায়ী ‘গুম’ হবে না। আক্ষরিক অর্থে তাকে ‘গুম’ বলায় অসুবিধা নাই। কিন্তু এই কনভেনশান অনুযায়ী ‘গুম’ বলার সঙ্গে তার পার্থক্য মনে রাখতে হবে। এই আক্ষরিক অর্থে ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ‘গুম’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশানের বিবেচনার মধ্যে পড়বে না।
কনভেনশানের উদ্দেশ্য অনুযায়ী তাকেই ‘গুম’ বোঝাবে যদি রাষ্ট্রের কোনো এজেন্ট, কিম্বা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে, সমর্থন পেয়ে বা মৌন সম্মতিতে কাউকে বিনা বিচারে আটক, অপহরণ বা অন্য কোন উপায়ে তার স্বাধীনতা হরণ করে, তারপর সেই ব্যক্তিকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তা অস্বীকার করে অথবা সেই ব্যক্তির কী দশা হোল বা সে কোথায় আছে তা লুকায় আর এইভাবে তাকে আইনের সুরক্ষার বাইরে স্থাপন করে। এই সংজ্ঞার সারকথাÑ ‘আইনের সুরক্ষার বাইরে কাউকে স্থাপন’ করার বিরোধিতার মধ্যে। এটাও লক্ষ্য করবার বিষয় যে রাষ্ট্র বা সরকারকে এই ক্ষেত্রে সরাসরি কোন নির্দেশ দিতে হবে এমন কোন কথা নাই। রাষ্ট্রের মৌন সম্মতিই (ধপয়ঁরংধহপব) যথেষ্ট।
এ ছাড়া এই কনভেনশানের আরো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তার মধ্যে ১ (২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট বলছে : এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন অজুহাত চলবে না। বলা যাবে না যে ‘গুম’ ঘটছে বিশেষ কোন পরিস্থিতির জন্য। যেমনÑ যুদ্ধ, যুদ্ধের হুমকি, আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অথবা অন্য যে কোন ধরনের জরুরি অবস্থা। কোন প্রকার বিশেষ অবস্থা ‘গুম’ করার পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য অজুহাত হিশাবে গৃহীত হবে না। এরপর অনুচ্ছেদ পাঁচে রয়েছে যে, যদি ‘গুম’ হওয়া বেড়ে যায় কিম্বা ‘গুম’ করে ফেলা রাষ্ট্রের নিয়মিত চর্চা হয়ে ওঠে তাহলে আন্তর্জাতিক আইনে যেভাবে ব্যাখ্যা করা আছে সে ব্যাখ্যা অনুযায়ী তা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিশাবে গণ্য হবে। ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ আন্তর্জাতিক আইনে অতিশয় নিন্দিত ও ক্ষমার অযোগ্য একটি অপরাধ। এর জন্য যে পরিণতি ঘটবার বা শাস্তি হবার কথা সেই শাস্তি থেকে নিস্তার পাবার সুযোগ নাই।
প্রথম আলো একটি উপসম্পাদকীয়তে মিজানুর রহমান খান লিখেছেন যে, “আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ (আসক) এবং ‘অধিকার’ আমাদের দুটি শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন। তারা গুমের বিষয়ে কাজ করছে। কিন্তু আন্তরিকতা সত্ত্বেও তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো একটি গুমকেও ‘প্রমাণিত ঘটনা’ হিসেবে দাবি করতে পারেনি। তারা সব কিছু করে শেষে বলে ‘সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ পাওয়া গেছে। ‘প্রমাণ পাওয়া গেছে’Ñ তারা একটুও বলতে পারে না” (দেখুন, “ইলিয়াসের ‘গুমের’ বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে”, ২২ এপ্রিল ২০১২)।

এই মন্তব্য একজন মানবাধিকার কর্মী হিশাবে আমার কাছে বিপজ্জনক মনে হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘আনুষ্ঠানিক ভাবে’ একটি গুমকেও ‘প্রমাণিত ঘটনা’ হিশাবে দাবি করতে পারে নি বলার অর্থ কী? তার মানে বাংলাদেশে কোনো গুমের ঘটনা ঘটেনি? মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিচার বিভাগ নয়, ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে প্রমাণ করবার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। গুমের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ‘সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ প্রমাণ করাই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দায়িত্ব। সেই অভিযোগ সত্য কি না এবং এর জন্য রাষ্ট্রের কোন বিভাগ বা কোন কর্তৃপক্ষ দায়ী সেটা তদন্ত করবার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের, বিচার করবার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। সর্বোপরি ‘গুম’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশান আত্মস্থ করে আইন প্রণয়ন করবার দায়িত্ব জাতীয় সংসদের। আর যদি তারা ব্যর্থ হয় তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে তার দায় সকলের। বাংলাদেশের বিচার বিভাগকেও সেই দায় নিতে হবে। তখন এই ‘সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ’ আন্তর্জাতিক নজরদারি ও বিচারের অধীন হতে পারে। গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশানে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের মৌনতা রাষ্ট্রকে দায় থেকে খালাস করে না।
‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ তাঁদের কথা বলবেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর উপদেষ্টা হিশাবে বলে রাখা দরকারÑ আমরা ২০০৯ সালে দুই জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, এবং ২০১১ সালে সালে ৩০ জন ব্যক্তি গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘গুম’ হবার কথা বলেছি। এই বছর ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ জন ব্যক্তি ‘গুম’ হয়েছেন। তার মানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের কোনো-না-কোনো এজেন্ট এই গুম হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
অনেকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘গুম’ হবার সংখ্যার হিশাবে মেলে না বলে বিভ্রান্ত হন। সেই দিক থেকে অধিকারের সংখ্যা কম হবার কারণ হচ্ছে, কেউ নিখোঁজ হলেই তাকে ‘গুম’ বলে সংজ্ঞায়িত করা ভুল। এটা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। এটা সংখ্যা দিয়ে সরকার বা রাষ্ট্রকে বিব্রত বা বিপদে ফেলবার ব্যাপার নয়, এটা সংজ্ঞার মামলা। রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত হয় এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ’ উঠতে পারে।
এই বিপদের কথা মনে রেখেই ‘অধিকার’ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ যেন গুম হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুমোদন দেয় তার জন্য প্রচার চালিয়ে আসছে। এই প্রচারের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই দিকে নজর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনার পর সেটা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

আজ দৈনিক সমকালে দেখছি কেবল দশ শর্ত মানলেই ইলিয়াস ‘মুক্তি’ পেতে পারেন। এই শর্তগুলো দেওয়া হয়েছে একই সঙ্গে ইলিয়াস ও বিএনপিকে। এর মধ্যে পাঁচটি শর্ত মানতে কিছুটা সম্মত হলেও বাকি শর্তগুলো কঠিন হওয়ায় বিএনপির হাই কমান্ড মানতে রাজি না। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, মুক্তি পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে নিজ থেকে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন ইলিয়াসকে এই কথা বলতে হবে। বলতে হবে, বিদায়ী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের ঘটনায় তার ড্রাইভারের প্ররোচনা ছিল। তিনি রাজনীতি করবেন না এমন প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে। এই সব। দেখুন, ‘১০ শর্ত মানলে মুক্তি ইলিয়াস আলীর’ (দৈনিক সমকাল, ২৩ এপ্রিল, ২০১২)। 
দৈনিক সমকালের এই খবর সঠিক নাকি প্রপাগান্ডা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। এই খবরের মূল সুর দুইটা : এক. ইলিয়াস ‘গুম’ হয়ে সরকারের কাছেই আছেন; দুই. বিএনপি এটা জানে এবং তাকে মুক্ত করবার জন্য ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের দেনদরবার চলছে। সমকালের এই প্রতিবেদন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ওপর ভিত্তি করে কোন মন্তব্য এখন অনুচিত। তবে এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে। এই ধরণের খবরের বিপজ্জনক দিক হচ্ছে ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরোধ হিশাবে হাজির করা। তার সমাধানও যেন দুই পক্ষের দেনদরবারের মধ্যেই নিহিত। ফলে ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভীষিকা ও তার তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের সম্পর্ক অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা ঘটে। ইলিয়াস যেন জীবিত ফিরে আসেন, এটাই এখনকার প্রধান প্রত্যাশা হওয়া উচিত। পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে তিনি ফিরে এলে বা না এলে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ‘গুম’ হওয়ার শিকার বলেই গণ্য হবেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি ‘গুম’ হওয়ার পরেও বেঁচে ফিরে এসেছেন বলে বিবেচনা করা হবে। রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে ‘গুম’ করেছে এই অপরাধ থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। একই সঙ্গে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। ক্ষমতাসীনদের জন্য ইলিয়াস আলী এখন শাঁখের করাত হয়ে গিয়েছেন। 
যদি সমকালের খবর সত্য হয় তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ক্ষমতাসীনরা চাইছে তিনি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছেনÑ এই কথা স্বীকার করিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক নিন্দা ও চাপের হাত থেকে আপাতত রেহাই পাওয়া। পরিস্থিতি যেখানে গিয়েছে তাতে এই দায় থেকে সরকারের নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন হবে। 
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব আসলে কাদের? কাদের কাছে তারা তাদের কাজের জবাবদিহি করে বা করতে বাধ্য। যদি ক্ষমতাসীনদের নির্দেশেই ‘গুম’ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে বাংলাদেশে জবাবদিহিতার সুযোগ নাই বললেই চলে। বিচার বিভাগের ভূমিকা থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিচার বিভাগও ক্ষমতাসীনদের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট ‘গুম’ করছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এলে একই ধরণের ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা নাই। তার মানে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গোড়ার প্রশ্ন উহ্য রেখে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বুঝতে হবে সাধারণ ভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের সঙ্গে রাষ্ট্র ও রজানীতির সম্পর্ক কোথায়। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির মানবিক ও নাগরিক অধিকারকে নিজের গাঠনিক ভিত্তি হিশাবে স্থাপন না করে, যদি ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য তার অন্তর্নিহিত চরিত্র বানিয়ে গড়ে না ওঠে তাহলে এই রাষ্ট্র ভেঙে নতুন করে বাংলাদেশ গড়া ছাড়া জনগণের সামনে আর কোন পথই খোলা নাই। এই ক্ষেত্রে মানবাধিকার-বিরোধী একটি ফ্যাসিস্ট দলের বিপরীতে মানবাধিকার-বিরোধী আরেকটি একনায়কতান্ত্রিক ও গণবিরোধী দলের পক্ষে দাঁড়াবার কোনই যুক্তি নাই। যে রাজনৈতিক দলগুলো মানবিক ও নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করে না, যারা জাতীয় সংসদে গিয়ে ১৪২ অনুচ্ছেদের শক্তি ব্যবহার করে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, সেই দলগুলোর কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? দেশে-বিদেশে খুনি বাহিনী হিশাবে খ্যাত র‌্যাব গঠন করেছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, নির্বাচনী বক্তৃতায় র‌্যাবের কর্মকাণ্ডের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগ সেই র‌্যাবকেই ব্যবহার করেছে। আজ অনেকে র‌্যাব ভেঙে দেবার কথা বলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যখন ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিল, তখন অবশ্য অনেককেই দোনমোনা করতে দেখেছেন। কথা হচ্ছে শুধু র‌্যাব ভেঙে দিলে হবে না, আরো বহু গোড়ার জিনিস ভেঙে নতুন ভাবে বাংলাদেশ গড়তে হবে। গড়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই।

অনেকে ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে হরতালে আপত্তি জানাচ্ছেন। তাঁদের যুক্তি, এতে মানুষের অসুবিধা হয়, ব্যবসাবাণিজ্যে বাধা তৈরি হয়, দেশের অর্থনীতি বিপদে পড়ে, হরতালের সময় গাড়ি ভাঙচুর হয়, নাগরিকদের সম্পদের ক্ষতি হয়, ইত্যাদি। হরতাল সফল করবার জন্য হরতালের আগের দিন ভয়ভীতি সঞ্চারের কর্মসূচি নেওয়া হয়। এতে জ্বালাও পোড়াও করতে গিয়ে নিরীহ নাগরিকদের পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে। এবারও গাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা গাড়ির চালক বদর আলী বেগ পুড়ে মরেছেন, তার সহকারী মোতালেব অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। গ্রামে বদর আলীর গরিব স্ত্রী, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনদের আহাজারি দেখেছি। কিছু দিন পর এদের নাম কারো মনে থাকে না। এরা হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে হত্যার চিহ্নগুলো বড় সহজেই মুছে যায়। এই সকল কারণে হরতালের বিরুদ্ধে নাগরিকদের ুব্ধ হবার বিস্তর কারণ আছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসুবিধা ছাড়াও মানবিক সংবেদনাও এখানে কাজ করে, যে সংবেদনা ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না। এই সকল যুক্তি অস্বীকার করবার কোন কারণ নাই। এমনকি এমন একটি ‘গুম’ ঘটে যাবার পরেও মানবাধিকার কমিশনের চেয়াম্যানও হরতালে আপত্তি জানিয়েছেন। বিশেষত, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তাদের কথা ভেবে তিনি হরতাল না করার মিনতি জানিয়েছেন। যদিও মানবাধিকারের দিক থেকে একজন নাগরিকের ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ভয়ানক দুঃসংবাদ। রাষ্ট্রের জন্য এটা খুবই বড় ধরনের সঙ্কট।
প্রহসন হোল হরতালের বিপক্ষে একই যুক্তি ক্ষমতাসীনরাও দিয়ে থাকে। গাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা একজন নিরীহ ড্রাইভার পুড়ে মরার পরপরই আওয়ামী লীগের নেতারা যেভাবে প্রতিপক্ষকে দায়ী করলেন তাতে বোঝা মুশকিল আসলে এই হত্যার জন্য কোন পক্ষ দায়ী। টেলিভিশনে বদর আলীর একজন আত্মীয়কে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুনেছিÑ দুই দলই এর জন্য দায়ী। তাদের রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষ। গণবিরোধী এই দুই পক্ষের বিরুদ্ধে গ্রামের একজন সাধারণ মহিলার সচেতনতা অর্থপূর্ণ মনে হোল। যত বেশি জনগণ অগণতান্ত্রিক, গণবিরোধী ও মানবিক অধিকারবিরোধী শক্তি ও শ্রেণীর বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠবেন ততই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ ও পদ্ধতি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
হরতালের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মুখে যে যুক্তি আমরা শুনি সেটা এর আগে বিএনপি ও চারদলীয় জোটের কাছেও আমরা শুনেছি। সেই গীত এখন শুনছি আওয়ামী লীগ ও তাদের মহাজোটের মহান সব সদস্যের মুখেও। ফলে নাগরিকদের ন্যায্য ক্ষোভ প্রকারান্তরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষেই কাজ করে। এটাই প্রহসন। বিএনপি অফিস বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব যেভাবে ঘিরে রাখে এবং বিরোধী দলের মিছিলে ও সভায় যেভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা করে তা অবিশ্বাস্য, কিন্তু এই কাজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়েও হয়েছে। তার মানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দলীয় স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। তাদের ব্যবহার করা যায়। যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দল তাদের ব্যবহার করে নির্দয়ভাবে বিরোধী প্রতিপক্ষকে দমন করবার জন্য। যে দল ক্ষমতায় যায় সেই দলের সন্ত্রাসী বাহিনী হিশাবে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহৃত হয়। নাগরিকদের সাংবিধানিক বা আইনি অধিকারের কোন তোয়াক্কা তারা করে না। কারণ ক্ষমতাসীনরা তাদের দায়মুক্তির দায় নিজেরাই তাদের কাঁধে নিয়ে নেয়, নিজেরাই বহন করে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক যে পরিস্থিতি তাতে নাগরিকদের লাগাতার আন্দোলন সংগ্রামে নেমে পড়বার কথা। এই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান চায় সকলেই, কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে বিএনপি ও তার অধীনস্থ জোটের সদস্যদের দলীয় সমর্থকরা ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামছেনা। অন্তত যেভাবে নামা উচিত সেভাবে নামছে না। এর কারণ বিএনপি জনগণকে কোন রাজনীতি দিতে পারছে না। আদৌ পারবে কি না সন্দেহ। স্রেফ আওয়ামী বিরোধিতা ও নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সকারের দাবি কোন রাজনীতি হতে পারে না। এই রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি রেখে বিএনপি ক্ষমতা চায়। ক্ষমতার হাতবদল চায়, কিন্তু রাষ্ট্রের কোন রূপান্তর চায় না। যে কারণে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংকটের চেয়েও সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্ন মানুষের কাছে বারবার বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও মানুষ তার বিরোধিতা করে। জানে, এর ফলে তাকে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির স্বীকার হতে হবে তার পরিবর্তে রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইতিবাচক কোন রূপান্তর ঘটবে না। কারণ সেটা ঘটাবার কোন দৃশ্যমান রাজনৈতিক কর্মসূচি মানুষের সামনে হাজির নাই। গুম ভীতিকর অবশ্যই। শুধু গুম নয়, ভবিষ্যৎ কর্মসূচির অনুপস্থিতিই বরং সবচেয়ে বেশি ভীতিকর। মানবিক অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাক্সা এবং তার পক্ষে রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের বিপরীতে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থ মুখ্য হয়ে যাবার এই প্রবণতাই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক।
২৩ এপ্রিল ২০১২। ১০ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২


ফেব্রুয়ারির পিলখানা : ভাষার মাস আর আগের মতো নাই

২০১২-০২-২৫

ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আবেগ, ভালবাসা ও রাজনীতির মাস। কিন' আমার অনুমান ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির ২৫-২৬ তারিখে পিলখানায় যে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটেছিল, তার পর থেকে ফেব্রুয়ারি ঠিক আগের মতো আর নাই। এর মানে এই নয় যে ভাষা, সাহিত্য বা সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের আবেগ উবে যাবে কিম্বা ভাষা ও সংস্কৃতি যেভাবে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় পরিগঠনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে সেই সব মুছে যাবে। এমনকি আগামি দিনে তার রূপ কী দাঁড়াতে পারে সেই সকল বিষয় নিয়ে বিবেচনার অবসরও আমাদের কমে যাবে। না, তা হবে না। সেটা বলছি না।

তাহলে ফেব্রুয়ারি আগের মতো আর নাই বলছি কোন অর্থে? এক দিক থেকে উত্তর দেওয়া সহজ। দুই হাজার নয় সালের ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ পিলখানায় একটি রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল। এই হত্যাযজ্ঞের কুফল বাংলাদেশের ওপর একটা কালো ছায়া ফেলেছে। এই অন্ধকার দীর্ঘস'ায়ী হতে বাধ্য। এটা হচ্ছে সহজ উত্তর। হতে পারে যে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ২৫ ও ২৬ তারিখকে আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাব, বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের দিক একটি বিচ্ছিন্ন ও গৌণ ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করব। তবে ২০১২ সালে এই দুটো দিন বিভিন্ন গণমাধ্যম কিভাবে হাজির করে তার মধ্য দিয়ে আমাদের স্মৃতিশক্তির মাত্রা সম্পর্কে খানিক আন্দাজ করতে সক্ষম হবো আমরা। দেখা যাক। 

কিন' যে অর্থে ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই বলছি তাকে এই ধরনের সহজ উত্তরের মধ্যে বোঝা যাবে না। যে অন্ধকার ছায়ার কথা বলছি সেটাও সম্ভবত ততোটা বিপদের নয়, যদি অন্ধকার থেকে সদর রাস-ায় উঠবার রাস-া সম্পর্কে আমাদের হুঁশ থাকত। মুশকিল হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাবার রাস-া আমাদের জানা নাই। সেটা পরিষ্কার ধরা পড়েছে বিডিআরের সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ থেকে আলাদা করে দেখা ও বিচার করবার ব্যর্থতা থেকে। অর্থাৎ ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে দুটো ঘটনা ঘটেছে। সেটা সমান-রালে ঘটেছে, নাকি বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেনা অফিসার ও তাদের পরিবারদের নির্যাতন ও হত্যার পরিকল্পনা আলাদা ভাবে করা হয়েছে, আমরা এখনো নিশ্চিত জানি না। তবে অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। ক্ষমতাসীন সরকারও তার দায়দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলা যাবে না। আসলে কী ঘটেছিল, কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছিল, অন্য কোন দেশ এর সঙ্গে জড়িত ছিল কি না- এই সকল নানান প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। এই জায়গাগুলোতে অন্ধকার এমনই জমাট বেঁধেছে যে সেখানে আলো প্রবেশ করবার সম্ভাবনা এখন খুবই ক্ষীণ।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বিদ্রোহ যে আলাদা সেটা হয়তো আমরা অনেকে আন্দাজ করেছি, কিন' আলাদা করে দেখা বা বিচার করার প্রয়োজনীয়তা বুঝি নি। যদি বুঝতাম তাহলে সাধারণ সৈনিকদের বিদ্রোহের সুস্পষ্ট কারণগুলোকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতাম। সেই কারণগুলোর দিকে নজর রাখলে এই উপলব্ধিও কঠিন হোত না যে এই ধরণের কারণ সেনাবাহিনীর মধ্যে জিইয়ে রাখা ব্রিজের নিচে ডিনামাইট ফিট করে রাখবার মতো আহাম্মকি। পুরা ব্রিজই যেকোন সময় উড়ে যেতে পারে। তাহলে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই আমরা বুঝতাম বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটা আমূল সংস্কারের দরকার আছে। এই কাণ্ডজ্ঞান যদি আমাদের থাকত তাহলে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা এবং সাধারণ সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার পথ সম্পর্কে সমাজে খোলামেলাই আলোচনা করতাম আমরা। এটা শুধু সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা নয়। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। কিন' সেটা আমরা করি নি। ডিনামাইট পাতাই রয়েছে। অতএব আমরা শুধু অন্ধকার জমিয়ে রাখিনি, সেই অন্ধকার সময়ে অসময়ে বিস্ফোরণের ব্যবস'াও পাকা করে রেখেছি। 

এই ঘটনার জন্য দায়ী বিডিআরদের বিচার করবার সময় আমরা চরম ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। হেফাজতে থাকা অবস'ায় নির্যাতনে অভিযুক্ত অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে সচেতন থেকে সাধারণ সৈনিকদের সুবিচারের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। এতে সেনা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে দূরত্ব কমে নি, বরং বেড়েছে। অন্য দিকে বিডিআরের নাম ও পোশাক পরিবর্তন করে পুরা বাহিনীকে হীনমর্যাদায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নামের মধ্য দিয়ে যাদের আমরা সীমানে- সশস্ত্র প্রতিরক্ষা বাহিনী বলে গণ্য করতাম তারা এখন হয়েছে সীমানে-র দারোয়ান মাত্র- বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড। তারা ‘ডিফেন্স রাইফেলস’ নয়, ‘বর্ডার গার্ড’। বাংলাদেশকে পরিকল্পিত ভাবে অরক্ষিত রাখবার পরিকল্পনাই সচেতন ভাবে বাস-বায়ন করা হয়েছে। এরপর সীমানে-র কাঁটাতারে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর গুলি খেয়ে ফালানীর লাশ আমরা ঝুলতে দেখেছি। দেখেছি কিভাবে ল্যাংটা করে বাংলাদেশীদের পেটানো হয়। শুনেছি, কিভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর তরফে বলা হচ্ছে সীমানে- গুলি চালানো বন্ধ হবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান- পৃথিবীর যেকোন সীমানে-র চেয়েও এখন রক্তাক্ত, লাশে ছিন্নভিন্ন। 

কিন' ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই তার উত্তরও এই সকল ব্যর্থতা ও ভয়াবহ অধঃপতনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে বিডিআরের ঘটনার সূত্র ধরে যে সকল ঘটনা ঘটেছে তার ফলে বাস-ব পরিসি'তির কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রশ্ন তোলা ও বিচার করার মধ্যে একটা গুণগত রূপান-র ঘটছে, এই অর্থেই বলছি ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই। বিডিআরের ঘটনার পরিণতি হিশাবে বাংলাদেশ নিজেকে রাষ্ট্র হিশাবে রক্ষা করবার ও বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস'ায় টিকে থাকবার ক্ষমতা হারিয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়েছে। সেনাবাহিনী নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে নির্যাতকের ভূমিকা হয়তো এখনো পালন করতে সক্ষম, এবং তা করতে গিয়ে সৈনিকতার মর্যাদা ধুলায় মিলিয়ে দিতেও হয়তো অনেকের দ্বিধা হবে না। কিন' এখন সেনাবাহিনী তার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি যেমন হারিয়েছে, তেমনি তার নৈতিক বলেরও ক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ, তার শক্তিও কম। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে নিজেকে রক্ষা করবার হিম্মত বাংলাদেশের কখনই হয়তো ছিল না। কিন' যে ন্যূনতম শক্তি ছাড়া একটি রাষ্ট্র নিজের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে না, সেই শক্তিও বাংলাদেশ এখন হারিয়েছে। বাংলাদেশ এখন সব অর্থেই অরক্ষিত। এই কাজ পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে কি না সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন' যা ঘটে গিয়েছে সেই পরিসি'তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া এখন আর সহজ নয়। বিশেষত সীমানে- কাঁটাতার ও নিরন-র কুকুরবিড়ালের মতো বাংলাদেশের মানুষ হত্যা, ফালানীর লাশ ঝুলে থাকা, পানির হিস্যা না পাওয়া, ভারতকে একতরফা করিডোর দিয়ে দেওয়া- ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি তা কিছুটা টের পাচ্ছি। তার পরেও দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মৈত্রী’র স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অনেকে আমাদের। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না। 

তাহলে কী দাঁড়াল? ফেব্রুয়ারি আগে ছিল ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ চর্চার মাস। এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে অভিন্ন সম্পর্ক সমাজে এত দিন অনুমান করা হয়েছে সেখানে অনেক দিন থেকেই সঙ্গত কারণে চিড় ধরেছে। মুশকিল হচ্ছে এই জাতীয়তাবাদ আমাদের একটি অখ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে না, বরং ভয়াবহ বিভাজন ও বিরোধ সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিকতার পরিগঠনের দিক থেকে এই বিপদগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। আমরা টের পাচ্ছি তথাকথিত ‘জাতি’ সত্তা বা নানান কিসিমের জাতীয়তাবাদের কেচ্ছা ও কল্পনার ভূত থেকে মুক্ত হয়ে একটি অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে নিজেদের পরিগঠন করতে হলে আমাদের শত্রু-মিত্র নির্ধারণের মানদণ্ড বদলাতে হবে। হয়তো প্রথাগত জাতীয়তাবাদী ধারণা এই নতুন বাস-বতা মোকাবেলায় আমাদের আর কাজে লাগবে না। আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই কর্তব্য উপলব্ধি করবার সামর্থ্য আদৌ আমাদের আছে কি না সেটা পরীক্ষার একটা চমৎকার সময় হাজির হয়েছে। ঠিক। এই অর্থেও ফেব্রুয়ারি আর আগের মতো নাই। 

আত্মপরিচয়ের বিড়ম্বনার বিচারে মোটা দাগে দুই ধরনের জাতীয়তাবাদী ভূতে আমরা আক্রান-। এক হচ্ছে মুসলমানি ভূত। মুসলমানরাই এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অতএব মুসলমানিত্বই এই দেশের মানুষের একমাত্র পরিচয় হতে হবে। এই দাবি করতে গিয়ে ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির জটিল সম্পর্ক ও টানাপড়েন অন্যায় ভাবে অস্বীকার করা হয়। ইসলাম আরব দেশের ধর্ম। এর সঙ্গে আরবি ও আরব সংস্কৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ক। কিন' ইসলাম যখন এই দেশে এসেছে তখন তাকে এই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বিকাশের সুবিধা খুঁজতে হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল বিকাশ ঘটিয়েছে। ইসলাম কায়েমের মানে নিশ্চয়ই স'ানীয় ভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষা, কিম্বা স'ানীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে আরব সংস্কৃতি আমল করার মধ্যে পর্যবসিত করা নয়। যদি মুসলমানিত্বই আমাদের পরিচয় হয়ে ওঠে তখন সেখানে একটা অনাবশ্যক ও অস্বাভাবিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে এই উপমহাদেশে ইসলাম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে শুধু নয়, জাতপাত শ্রেণীর পার্থক্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে তাকেও নাকচ করে দেওয়া হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এই উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস থেকে অভিন্ন নয়। এই আত্মপরিচয়ের ভূত একাত্তর সালে আমাদের কাঁধ থেকে নেমে যাবার কথা ছিল। পাকিস-ান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রাম এই ভূতকে কাঁধ থেকে নেমে যেতে বাধ্য করেছিল। তখন ইসলামের সঙ্গে আমাদের একটি ঐতিহাসিক ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হবার বিপুল সুযোগ তৈরি হয়। কিন' আমরা তা হেলায় হারিয়েছি। তাকে কাজে লাগাই নি।

কিন' ইতোমধ্যে আমাদের কাঁধে দ্বিতীয় ভূত চাপে। এই ভূত দাবি করতে থাকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়া আমাদের আর কোন পরিচয় নাই। ইসলাম তো নয়ই। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলামকে শত্রু হিশাবে হাজির করতে থাকে। আগের ভূতের মতো এরাও উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকা বিশেষত জাতপাত-বিরোধী লড়াই এমনকি ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামের ভূমিকাকে অস্বীকার করে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাদের অবস'ান হয় মূলত ইসলামের বিরোধিতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিজেদের গড়ে ওঠার ইতিহাসের দিকে আরো বিস-ৃত, ব্যাপক ও গভীর ভাবে তাকাবার সুযোগ করে দিয়েছিল, কিন' এই ভূত আমাদের আরো অন্ধ করে দেয়। তাদের দাবি হোল, বাস-ব ইতিহাস নয়, একমাত্র ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের পরিচয়ের একমাত্র ভিত্তি। এক প্রকার ‘আবহমান বাংলা ও বাঙালির’ কল্পনা করা হয়, যাদের সঙ্গে কখনো ইসলামের মোলাকাত হয়েছে বলে প্রমাণ নাই। সকল নজির গরহাজির হয়ে যায়। ধর্মীয় সামপ্রদায়িকতার বিপরীতে তৈরি হয় আরেক উগ্র ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক সামপ্রদায়িকতা। আমরা বাঙালি- এর অর্থ আদতে গিয়ে দাঁড়ায় ইসলাম-বিরোধী হওয়ার বীরত্বে, বাঙালির জীবনযাপন ও ইতিহাস থেকে ইসলামকে জবরদসি- বাদ দেওয়ার অস্বাভাবিকতায়। এমনকি ইতিহাস সম্পর্কে যাঁদের কাছ থেকে সচেতনতা আশা করা গিয়েছিল তাঁরাও অনায়াসে লিখলেন মুসলমানরা ঘরে ফিরে এসেছে, তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। যার প্রচ্ছন্ন অর্থ দাঁড়ায় এই জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে ধর্মান-রিত হয়ে ভুল করেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে তারা আবার ‘বাঙালি’ হয়েছে। নিজ দেশ সে ত্যাগ করে গিয়েছিল, এখন আবার প্রত্যাবর্তন করেছে। ইত্যাদি। 
আগের ভূত দেখল এতো ভারি সুবিধা। ইতিহাসের এই ফাঁকির জায়গায় যে ভূত আমাদের কাঁধ থেকে নেমে গিয়েছিল বলে একাত্তরে আমরা ভেবেছিলাম সেই ভূত আরো শক্তি নিয়ে আবার আমাদের ঘাড়ে চেপে বসল। তারা সহজেই দাবি করতে পারল ‘বাঙালি’ হওয়ার কথা বলে আমাদের আসলে ‘হিন্দু’ বানানো হচ্ছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের চর্চার নজির দেখিয়ে এই প্রচারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা কঠিন ছিল না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কল্যাণে আমাদের কাঁধে এখন একটা নয়, দুই দুইটা ভূত এক সঙ্গে সওয়ার করেছে। মারহাবা। আমাদের হানাহানি রক্তপাত রাজনৈতিক বিভাজন ও অসি'তিশীলতার গোড়ায় রয়েছে এই দুই ভূতের কোন্দল। এই কোন্দল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাংলাদেশ আদৌ রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকতে পারে কি না সেটাই সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। 

যদি আমরা বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে দুই ধরণের ভূতের কারবার ছাড়তে হবে। এক হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতির জায়গায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক শত্রু-মিত্র বিভাজন আর অন্য দিকে ধর্মের জায়গায় দাঁড়িয়ে শত্রু-মিত্র নির্ণয় করবার কারবার। অর্থাৎ এই দুই ধরণের সামপ্রদায়িকতা আমাদের শত্রু। এই দোষ ত্যাগ করলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ও আরবসভ্যতার সম্পর্ক নিজের গতিতেই এগুবে। রাজনৈতিকতার পরিমণ্ডলে কিম্বা রাষ্ট্র গঠনের পরিমণ্ডলে বারবার বিপদ ডেকে আনবে না। 

আমাদের উপলব্ধি করতে হবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে বাংলাদেশকে দুই ভাগে ভাগ করলে আমরা টিকে থাকতে পারব না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই বিভাজনের মীমাংসার জন্য যে ইতিহাস চেতনার দরকার আমরা তা অর্জন করি নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের দিক থেকে যদি দেখি তাহলে আমাদের সমস্যা আসলে মুসলমান বনাম বাঙালি হবার দ্বন্দ্ব নয়, বরং এই উপমহাদেশে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে টিকে থাকবার সমস্যা। শুধু তা-ই নয়, এই উপমহাদেশে সকল নির্যাতিত জাতি, বর্ণ, শ্রেণীর পক্ষে লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করার মধ্য দিয়েই আমাদের বিকাশ ঘটবে। এই লড়াইয়ের জায়গায় দাঁড়িয়েই ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন করে বিচার ও বিবেচনা করতে আমাদের শিখতে হবে। 

আমার ধারণা, নিজেদের সংকট উপলব্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের জনগণ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। কিন' রাষ্ট্র গঠনের অন্যান্য প্রশ্ন মীমাংসার আগে বাংলাদেশের সামনে প্রধান বিপদ হিশাবে হাজির হয়েছে ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী বা সংক্ষেপে দিল্লি। দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কূটনৈতিক ভাবে মোকাবিলার সুযোগ নাই বললেই চলে। শুধু পানি নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশের বিরোধ আরো তীব্র হতে বাধ্য, যা মূলত পুরা উপমহাদেশকেই অসি'তিশীল করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান- পরিসি'তি এতোই নাজুক হয়ে উঠেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিজেরাই উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে এখন। এই দিক থেকেও দুই হাজার নয় সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা এবং তার পরিণতিতে সীমান-রক্ষী বাহিনী হিশাবে বিডিআরের পরিবর্তনকে বাংলাদেশের জনগণ সহজ ভাবে মেনে নিচ্ছে না। এর অভিপ্রকাশ কিভাবে ঘটবে এখনো তা পরিষ্কার নয়। রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রশ্ন যদি আসে তাহলে সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন' প্রথাগত সেনাবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশ রক্ষা অসম্ভব। বাংলাদেশকে অবশ্যই গণপ্রতিরক্ষার পথে অগ্রসর হতে হবে। এর সহজ মানে হচ্ছে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীকে নিলে চলবে না, এই দায়িত্ব সকল নাগরিককের। গণশক্তির লালন ও বিকাশ ছাড়া বিচ্ছিন্ন সামরিক শক্তি দিয়ে দিল্লির সঙ্গে মোকাবিলা সম্ভব নয়, বাস-ব পরিসি'তি এই সত্য উপলব্ধির জন্য এখন অনেক সহায়ক হয়ে উঠেছে। 

ফেব্রুয়ারি ভাষা ও সংস্কৃতির রাজনীতিকরণ ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে এতকাল ভাষা ও সংস্কৃতির মানদণ্ড দিয়ে বুঝতে চেয়েছে। আমার অনুমান, এই পর্যায় আমরা দ্রুত অতিক্রম করছি। দুই হাজার নয় সালের ২৫-২৬ তারিখের ঘটনাবলি ও তার পরিণতি বিচার করলে ফেব্রুয়ারি আমাদের গণপ্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভাববার জন্য তাগিদ দিয়ে যেতে থাকবে। 
ঠিক। ফেব্রুয়ারি আর আগের জায়গায় নাই। 
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২। ১২ ফাল্গুন ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com

প্রতিরক্ষার কর্তব্য শুধু সেনাবাহিনীর নয়, প্রতিটি নাগরিকের



২০১২-০২-০২

দুই হাজার আট সালে নভেম্বরের শেষের দিকে আমি দৈনিক নয়া দিগন- (২৫.১১.২০০৮) পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল “সেনাবাহিনী থেকে ইসলামি ভূত তাড়ানোর ‘সেকুলার প্লান”। হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ নামক পত্রিকায় ১৯ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ইরাক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন সামরিক অফিসার কার্ল সিওভাক্কো যৌথ যে নিবন্ধ লিখেছিলেন সেটা পড়ে বাংলাদেশে কী ঘটতে পারে তার একটা আন্দাজ করতে চেয়েছিলাম। সজীব ওয়াজেদ জয় একজন ব্যক্তিমাত্র নন। তিনি শেখ হাসিনার সন-ান, ফলে মায়ের চিন-াচেতনা ও ধ্যানধারণার ওপর তার একটা প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। কিন' রক্তের সম্পর্ককে আমি গুরুত্ব দিয়ে দেখি নি। বরং গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি তার আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনার উপদেষ্টা পদে থাকা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে কী করবেন তার একটা আগাম পাঠ ওই লেখার মধ্যে ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের বদৌলতে কোনো একটি দল ক্ষমতায় আসা মানে মূলত একজনের রাজত্ব বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন বলবৎ করা। যে কারণে দলীয় প্রধান হিশাবে যিনি ক্ষমতায় আসেন তিনি নিজেকে বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিপতি বলেই মনে করেন। যিনি মনে করেন দোষ তো তার নয়। যদি সংবিধানেই আমরা সে ব্যবস'া রেখে দিই তাহলে অপরাধ তো আমাদেরই। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান- বিশেষত ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে ক্ষমতার চরিত্র একনায়কতান্ত্রিক হতে বাধ্য। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না, তেমনি নির্বাচন করলেই এ ধরনের সংবিধানের একনায়কী আবর্জনা সাফ হয় না। এই একনায়কী শাসনকে সাংবিধানিক ভাবে বোঝার জন্য একে ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র’ বলা যায়। আমার লেখালিখিতে সব সময় তাই বলে এসেছি এবং বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ভাবে গড়বার জন্য নতুন একটি ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) কেন দরকার বিভিন্ন সময় তার যুক্তি হাজির করেছি। 

তাহলে সাংবিধানিকভাবে সিদ্ধ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিশাবে মার্কিন সামরিক অফিসার কার্ল সিওভাক্কোর সঙ্গে সজীব ওয়াজেদ জয় যে পরিকল্পনা হাজির করছেন তাকে বাস-বায়ন করা মোটেও কঠিন কিছু নয় বলেই আমার মনে হয়েছিল। একনায়কী শাসনের এই এক সুবিধা। লিখেছিলাম জয়-সিওভাক্কোর নিবন্ধটি পড়ে ‘আমরা উপকৃত হয়েছি। কারণ বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটবে তার একটা আগাম সংকেত পেয়েছি আমরা’। সেই সংকেতটা কী সেটাই আমি আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এখানে সেই লেখার পুনরাবৃত্তি করব না। আমার অনুমান ঠিক ছিল কি না সেটা পাঠক এখন আবার পড়ে এখনকার ঘটনা নিজেই বিচার করে দেখতে পারেন। 

বলাবাহুল্য সেই আগাম সংকেত পাবার পরেও বাংলাদেশ নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে কি না, কতটুকু পেরেছে বা না পারলেও তার আশু কর্তব্যগুলো কী হতে পারে সে বিষয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ভাবা দরকার। সেনাবাহিনীর ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুথান’কে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগ যেভাবে সেনাবাহিনীর কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা কর্তৃক অন্যদের দুরভিসন্ধিমূলক ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে... বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করা অর্থাৎ শেখ হাসিনার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালিয়েছে বলে ছকে বাঁধা প্রচার করেছে সেই প্রপাগান্ডা কাজ করে নি। সেনাবাহিনীতে কোন ‘বিশৃংখলা’ বা অভ্যুত্থানের চেষ্টা কোন ‘ধর্মান্ধ কর্মকর্তা’ করল নাকি কোন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কর্মকর্তা করল- প্রতিষ্ঠান হিশাবে তাতে কিছু আসে-যায় না। সেনাবাহিনীর দিক থেকে শৃংখলা ভঙ্গ করলেই- সেটা ধর্মের নামে হোক, কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হোক- কিম্বা হোক জাতিকে দুই নেত্রীর কবল থেকে বা দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত করবার কথা বলে ক্ষমতা দখল করবার চেষ্টা- যে ছুতাতেই হোক সেটা সেনা আইনে অপরাধ। সেনাবাহিনী তাদের বিচার করতে বাধ্য। 

দেশের ভেতরে এই ছকে বাঁধা প্রচারের ফল কী হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। আমার অনুমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই প্রচার বিশ্বাস করে নি। তবে আসলে কী ঘটেছে জানার আগ্রহীর সংখ্যা কম নয়। এটাও বোঝা যায় চট্টগ্রামে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার কিছু বক্তব্যের সূত্র ধরে তাকে অভিযুক্ত করবার আওয়ামী কৌশলও কাজ করে নি। কিন' বিএনপির আঠারোই ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে যে সহিংসতা ঘটেছে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ উঠেছে, তার দাগ বিএনপি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না। এই অনুমান অনেকের মধ্যেই দানা বেঁধেছে যে দ্রুত ক্ষমতায় যাবার আশায় এই দলের মধ্যে কিছু হঠকারী শক্তির সমাবেশ ঘটেছে। এরা হয়তো বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই কিছু একটা করে ফেলতে চায়। বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক বাস-বতার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার পণ্ড করবার জন্য জামায়াতে ইসলামী নৈরাজ্যের রাজনীতি উসকে দিতে পারে- অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল আশংকা রয়েছে। তাদের মধ্যে এই ছকে বাঁধা প্রচারকাজ করেছে। তবে এই প্রচারের পক্ষে সবচেয়ে বড় ইন্ধন জুগিয়েছে হিযবুত তাহরীরের পোস্টার ও প্রচারপত্র। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন- যুদ্ধের অংশীদার বাংলাদেশের সুশীলসমাজ এই সকল পোস্টার ও প্রচারপত্র আশ্রয় করে বাংলাদেশে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বিভাজন-রেখাকে আরো মোটা ও দৃশ্যমান করে রাখবার আরেকটি ভালো সুযোগ পাবে। তারা তাদের সমস- প্রতিভা দিয়ে তার সদ্ব্যবহার করবে। তাদের পত্রিকায় সেই অবিরত চেষ্টা আবার শুরু হয়ে গিয়েছে। এই প্রচারে হিযবুত তাহরীরের নগদ লাভ হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের একটা বড় অংশ তাদের কীর্তিতে অনুপ্রাণিত বোধ করবে। দলের শক্তি এতে বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা আছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে সদস্য সংগ্রহের সাফল্য ও অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রয়াসের যে কীর্তিকথা সেনাসদরের তরফে প্রচার করা হয়েছে, তাতে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এই দলের পরিচিতি বাড়বে। এর মধ্য থেকে সেই পুরানা শিক্ষাটা আমাদের নতুন ভাবে পাঠ করতে হবে যে যারা মৌলবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাসের কথা বলে তারা সেটা নানান কায়দায় তৈয়ারও করে। কেউ সজ্ঞানে, কেউ না জেনে। কিন' করে। 

কিন' আন্তর্জাতিক ভাবে এই প্রপাগান্ডা গ্রহণযোগ্যতা পায় নি সেটা পরিষ্কার। হতে পারে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পরেও কুশাসন, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, দুর্নীতি, ক্রমাগত মানবাধিকার লংঘন, মানুষ গুম করে ফেলা ইত্যাদি কারণে মহাজোট সরকারের অযোগ্যতা এতই প্রতিষ্ঠিত যে, এই প্রচারকে সেই আযোগ্যতা ঢাকা দেওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা হিশাবেই দেখা হয়েছে। সীমানে- হত্যা ও কিশোরী ফালানীর মতো নিষ্পাপ মেয়েদের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা এবং বিএসএফের মানুষ উলঙ্গ করে নির্মম ভাবে পেটানোর পরেও দিল্লির প্রতি শেখ হাসিনার সরকারের মনোভাব এটাই প্রমাণ করেছে যে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের যদি স্বাধীন আঞ্চলিক ভূমিকার কোন সম্ভাবনা থেকেও থাকে এখনকার ক্ষমতাসীনদের দিয়ে তার বাস-বায়ন সম্ভব নয়। এই সরকারের প্রতি আন-র্জাতিক সমর্থন এই কারণেও কমছে। তা ছাড়া সেনাতরফে যে লিখিত বক্তব্য হাজির করা হয়েছে, তার দলীয় চরিত্র এতই স্পষ্ট যে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা সেনাবাহিনীর সংবাদ সম্মেলন ও লিখিত বক্তব্যের গুণেই কর্পূরের মতো হাওয়ায় উবে গিয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে এখন অনেক বেশি উন্মুখ। সৈনিকতার মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠানের পেশাদার চরিত্র বহাল রাখবার অক্ষমতাও প্রকট হয়ে উঠেছে। নিজেদের মর্যাদা তারা নিজেরাই মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।
বিএনপি, জামায়াত, হিযবুত তাহরীর ও ‘সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা’ বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টা করেছে, এই চেষ্টা যে আন-র্জাতিক ভাবে গ্রহণযোগ্য হয় নি দিল্লি সেটা অনায়াসেই টের পেয়েছে। এই প্রথম দিল্লির পক্ষে প্রচার খুব একটা কাজে আসে নি। এরপর দিল্লির স্বার্থ বজায় রাখতে হলে প্রচারের ধরন কী হতে পারে সেটা খুঁজতে গিয়ে গালফ নিউজে কুলদীপ নায়ারের লেখাটি পড়েছি। কুলদীপ লেখাটি লিখেছেন জানুয়ারির ২৮ তারিখে, সেনাসদরের তরফে ১৯ তারিখে সংবাদ সম্মেলন করবার ৯ দিন পর। তত দিনে সংবাদ সম্মেলনের আঞ্চলিক ও আন-র্জাতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা হয়ে যাবার কথা। দেখলাম কুলদীপ শুরুই করেছেন ভারতীয় গোয়েন্দাদের কীর্তির সাফাই গেয়ে। লিখছেন, ‘অভ্যুত্থান বা ষড়যন্ত্রের চেষ্টা ঘটে যাবার ওপর ধূলাবালি থিতু হয়ে যখন বসল তখন নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'াগুলো সেনাবাহিনীর ওপরওয়ালাদের কাছে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। এই বার বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সময়মতো কাজ করে আর বিদ্রোহ অংকুরেই পিষে ফেলে।’ তাঁর দাবি, এর আগেও ১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস'াগুলো সেনাবাহিনীকে সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানিয়েছিল, কিন' তখন যেহেতু সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই অভ্যুত্থানের হোতা ছিলেন, অতএব সেই সতর্কতায় কাজ হয় নি। শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিবারবর্গের অনেক সদস্য সঙ্গে নিয়ে নিহত হয়েছেন। 

কুলদীপ বলছেন, সেনাবাহিনী যে ক্ষমতা নিতে চায় না তার প্রমাণ হোল কিছু দিন আগে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ফিরে এলে তার হাত ধরে আবারও দুর্নীতি ফিরে আসবে এটা জানা সত্ত্বেও সেনাবাহিনী রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছে। বিএনপি বা চারদলীয় জোট যদি ক্ষমতায় আসত তাহলে এই কথা কুলদীপ বলতেন কি না সন্দেহ। এবারের বিশৃংখলা বা অভ্যুত্থানের মতো কুকাজ যে সেনাবাহিনীর মধ্যে ধর্মান্ধ লোকজনই করেছে, সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন কুলদীপ। এই ধরনের লোকজন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যেমন আছে, বাংলাদেশেও ঢুকে পড়ছে। সেনাসদরের তরফে সংবাদ সম্মেলনে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে কুলদীপ নায়ারের বক্তব্যের বিশেষ অমিল নাই। কিন' কুলদীপ নতুন একটি তথ্য যোগ করেছেন সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। 

তিনি বলছেন, “আমার কাছে এমন তথ্য আছে যে,এবার অভ্যুত্থানের নেতারা এমন কিছু শক্তির কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে যারা ভারত থেকে তৎপরতা চালায়। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসমের (উলফা) একটি অংশ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। কথাটা খাটে বৈরী নাগাদের বেলায়ও। মনিপুরের বিদ্রোহীরাও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। এটা বিস্ময়কর যে, বাংলাদেশ এখন তার ভূখণ্ড থেকে কোনো ভারতবিরোধী শক্তিকে তৎপরতা চালাতে না দিলেও ভারত এ ক্ষেত্রে ঢিলেমি ও নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় দিচ্ছে।”

এই ‘তথ্য’টা নতুন। সেনাসদরের তরফে যে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই ধরনের কোন অভিযোগ নাই। বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে নয়, বাংলাদেশের সেনা অভ্যুত্থানের নেতাদের সাহায্য করেছে ভারত থেকে উলফার একটি অংশ, বৈরী নাগা ও বিদ্রোহী মনিপুরিরা। কুলদীপ নায়ার তার কাছে এই তথ্য আছে বলে দাবি করেছেন, অতএব এই বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নাই। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, তদনে-র স্বার্থে তিনি এই তথ্য গোপনও রাখতে পারতেন। কিন' তা করেন নি। প্রশ্ন হচ্ছে, ফলাও করে এই তথ্য প্রচার করছেন কেন?
যেটা বুঝতে পারি, কুলদীপ নায়ার প্রমাণ করতে চান বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে যা কিছু ঘটছে সেটা বাংলাদেশের অভ্যন-রীণ ব্যাপার মাত্র নয়, সেটা ভারতের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা গেলে শেখ হাসিনাকে ‘সব রকমের সাহায্য’ দেবার পক্ষে ভারত অনায়াসেই আন-র্জাতিক যুক্তি ও বৈধতা খাড়া করতে পারে। ভারতের এই সবরকম সাহায্যের মধ্যে বাংলাদেশে গোয়েন্দা ও সামরিক হস-ক্ষেপও অন-র্ভুক্ত। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অভ্যন-রের কোন তৎপরতা যদি ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়, তাহলে বাংলাদেশে হস-ক্ষেপ করবার অধিকার আছে ভারতের। ভারতের বিরুদ্ধে প্রধান একটি অভিযোগ হচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতা। বাংলাদেশের সেনা অফিসারদের ভারতীয় গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে- এই অভিযোগ খুবই স্পর্শকাতর। এই অভিযোগের বিপরীতে ভারতের পক্ষে কুলদীপ একটা যুক্তি খাড়া করতে চাইছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি বিদ্রোহী, উলফা, নাগা ও মনিপুরিদের যোগসাজশ আছে বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান। যদি তা-ই হয় তাহলে ভারত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার স্বার্থে বাংলাদেশে যে-কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। ক্ষমতাসীন সরকার দিল্লির মিত্র। হয়তো সরকারের কাছে অনুমতি নিয়েই তারা তা করছে। শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কিছু ঘটলে ভারত যে চুপ করে থাকবে না সেই দিকটাও তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন। 
সেনাবাহিনীতে ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুত্থান’ ঘটাবার কোন প্রয়াস থাকুক বা না থাকুক, বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর থেকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় নীতি আগাগোড়া ভারতের প্রতিরক্ষা ও সামরিক নীতির অধীনস'। দুই দেশের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করা, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে করিডোর দেওয়া, বিডিআরকে ‘বর্ডার গার্ড’ অর্থাৎ সীমানে-র দারোয়ানে পরিণত করা ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যেই আমরা সেই নীতিরই বাস্তবায়ন দেখি। এই অভ্যুত্থানের প্রয়াসকে দিল্লি একটি বিশাল সুযোগ হিশাবে গ্রহণ করবে। কুলদীপ অবশ্য সেটা খোলামেলাই বলেছেন, ‘এবারকার ব্যর্থ অভ্যুত্থান শুধু একটি সতর্ক বার্তাই নয়, একই সাথে দিল্লি সরকারের জন্য ছিল একটি সুযোগও’। তিনি ঠিকই ধরেছেন এবং ঠিকই বলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমরা এক শ’ ভাগ একমত হতে পারি। অবসর ও বদলির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে যে অদলবদল চলছে, সেই রূপান-রের প্রক্রিয়া এখন ত্বরান্বিত হবে। সেনাপতি মইন ইউ আহমেদের সময় থেকে ভারতের সামরিক ও প্রতিরক্ষানীতির বাইরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর স্বাধীন কোন অসি-ত্ব আশা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। এখন তা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। যেটা আমাদের বুঝতে হবে, কারো কারো জন্য যতই বেদনাদায়ক হোক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটা সংস্কার বা পুনর্গঠন চলছে। সেই ক্ষেত্রে কেউ ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুত্থান’ সৃষ্টির ব্যর্থ প্রয়াসে অংশগ্রহণ করে সেই পুনর্গঠনের ফাঁদে পা দিচ্ছে, আর কেউ সেই প্রয়াস দমন করে পুনর্গঠনকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলছে। 

গত বছর নভেম্বরের ২৬ তারিখে কুলদীপ নায়ার গালফ নিউজেই আরেকটি লেখা লিখেছিলেন। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে, এই বাস-বতা টের পাবার জন্য তাঁকে জেগে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি (Hasina has to wake up to the reality)। তবে প্রধানমন্ত্রী তার পরামর্শে জেগে ওঠেন নি, এটা নিশ্চিত। এবারের লেখাতেও তিনি স্বীকার করেছেন যে শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের মোহ কেটে গিয়েছে। কিন' দিল্লিকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা যে বাংলাদেশের পাশেই থাকবে এটা যেন তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধ কূটনৈতিক মীমাংসার বাইরে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। দিল্লির সঙ্গে পানির বিবাদ মিটবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অসম বাণিজ্যের পার্থক্য বাড়তেই থাকবে, কমবার কোন সম্ভাবনা নাই। সীমানে- বিএসএফের হত্যা ও নির্যাতন কমবে না। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়বে এবং বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের সুযোগ কমবে। ইত্যাদি নানা কারণে দিল্লির বিরোধিতার রাজনীতি বাড়বে। হয়তো বাংলাদেশের প্রতি এটাই দিল্লির নীতি। যাতে দিল্লির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভ আরো বাড়ে এবং তার পরিণতিতে দিল্লির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিরোধও আরো প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আর তখন যেকোন প্রতিরোধকেই ধর্মান্ধদের চেষ্টা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে ইসলামি মৌলবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাসীদের হামলা হিশাবে অভিহিত করা দিল্লির পক্ষে সহজ হবে। ইসলামের নাম নিয়ে নতুন-পুরাতন বড়-ছোট অনেক দল তখন পাওয়া যাবে যারা জেনে বা না জেনে দিল্লির ফাঁদে পা দেবে। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা দিল্লির পক্ষে তখন অনেক সহজ হবে। সমাজের সর্বত্র ক্ষোভ-বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে। তার প্রকাশ কোথায় কিভাবে ঘটবে আমরা জানি না। সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করবার আহাম্মকি বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনবে।

বলাবাহুল্য বাংলাদেশ একটি সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। এর পরিণতি কী দাঁড়ায় আমরা এখনো সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে প্রপাগান্ডায় বিশ্বাস না করা। আসলে কী ঘটছে সেই দিকে আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা প্রথম কাজ। এখন এই উপলব্ধিটুকু দরকার যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার কর্তব্য শুধু সেনাবাহিনীর নয়, প্রতিটি নাগরিকের। কিন' বিদ্যমান সংকট আমরা অচিরেই সমাধান করতে পারব না। কারণ এখনো রাষ্ট্রগঠন ও গণপ্রতিরক্ষার প্রশ্নকে আমরা জাতীয় প্রশ্ন হিশাবে তোলা ও তার মীমাংসার জন্য তৈরি হতে পারি নি। আমাদের রাজনীতির প্রধান ইস্যু এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা-না-থাকা এবং তার অধীনে নির্বাচন হওয়া-না-হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। মহাজোটের পরিবর্তে চারদলীয় জোটকে ক্ষমতায় বসানোর মধ্যে কোন সমাধান নাই। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে পারবে বলে মনে করে, ফলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। কিন' ক্ষমতায় গেলে তারা কী করবে তার কোন ইঙ্গিত, ইশারা বা প্রস-াব নাই। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে বাংলাদেশকে এক দিকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা এবং অন্য দিকে রাষ্ট্র হিশাবে গড়ে তুলবার যে একটা কর্তব্য রয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে আমরা চরম ভাবে উদাসীন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস'ান গড়ে তোলাই এখনকার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে আমরা একক সত্তা নই। দলবাজি ও মতাদর্শিক গোঁড়ামির বাইরে আসতে হলে আমাদের নিদেনপক্ষে এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু দরকার যে রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে শক্তি ও সৈনিকতার ভূমিকাকে আমরা যেন কোনভাবেই খাটো করে না দেখি। ঠিক যে প্রথাগত সেনাবাহিনী বিত্তবানদের সম্পত্তি পাহারা দেয়। ধনীর পক্ষ হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। গুলি ছোড়ে। কিন' দেশ ও জনগণের স্বার্থের পাহারাদারি ও সুরক্ষার জন্য কিভাবে শক্তি ও সৈনিকতার পুনর্গঠন করা যায়- সেই ব্যবহারিক আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দলবাজির নোংরামি ও মতাদর্শিক গোঁড়ামির খানাখন্দ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি। নইলে বড় ও ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের দাসানুদাস থাকাই হয়তো আমাদের নিয়তি হয়ে উঠবে। তার নমুনা কেমন হতে পারে তার স্বাদ গত তিন বছরে আমরা পেয়েছি। 
হয়তো দাসত্বতেই আমরা আরাম বোধ করি। কে জানে। ভবিষ্যৎই তার উত্তর দেবে। 
১ ফেব্রুয়ারি ২০১২। ১৯ মাঘ ১৪১৮। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com