॥ ফরহাদ মজহার ॥
১.
হিলারি কিনটন শুধু বাংলাদেশে আসছেন না। প্রথমত তিনি আসছেন চিন থেকে। তারপর তিনি আসবেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে যাবেন ভারতে। কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন। তাঁর বাংলাদেশ সফরকে দিল্লী-ঢাকা-ওয়াশিংটন মিলে চিনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার সফর হিশাবে দেখতে চাইছেন অনেকে। এটা খুবই সরল ভাবে দেখা। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং ভাঙন বেসামাল হয়ে পড়ছে প্রায়ই। এর কারণে শক্তিশালী দেশগুলোর সামরিক ও নিরাপত্তা ভাবনা নতুন বাস্তবতায় বদলাচ্ছে। এর রূপ ঠিক কী দাঁড়াবে সেটা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাও আগের মতো তীব্র নয় এবং এই বৈরিতা চিরস্থায়ী হবে সেটাও আগাম অনুমান করা অসম্ভব। এটা ঠিক যে নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ টিকিয়ে রাখবার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। সন্দেহ নাই, সেই ক্ষেত্রে চিনকে সামাল দেওয়ার একটা চিন্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারতের আছে। শুধু এই দিকে নজর নিবদ্ধ রাখলে মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কের নীতিগত ও কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটছে কিনা সেটা আমরা ধরতে পারব না। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন একতরফা ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছেড়ে দেবে, এটা ভাবাও ঠিক নয়। ফলে এই তিনটি দেশের স্বার্থের ঐক্য এবং বিরোধ দুটো দিকই নজরে রাখা দরকার।
যারা বলছেন, এই সময়ে হিলারি কিনটনের বাংলাদেশে আসা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেবারই নামান্তর, তারা খুব ভুল বলছেন না। বিশেষত এর আগে না আসবার কথা বলে এবং এই বিশেষ অস্থির রাজনৈতিক সময়টা বাংলাদেশে আসার জন্য বেছে নিয়ে হিলারি কিনটন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবাদে সমর্থনই জোগালেন। অথচ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরেও বেগম খালেদা জিয়া বিদেশি মেহমানদের সম্মানে কোন কঠোর কর্মসূচি দিলেন না। তার সঙ্গে হিলারি কিনটন সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাত যেন বেসামাল না হয় সেই ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন অবশ্যই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক উত্থান পতনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়। বিদেশি শক্তিগুলো এই কারণেই রাজনৈতিক সংঘাত সীমা ছাড়িয়ে গেলে বিচলিত হয়। অন্যদিকে দুই পক্ষের এই সংঘাতের সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা গুণগত স্তরে উন্নীত করার চেষ্টাও করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখা যাক কী দাঁড়ায়।
২.
চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। পারমাণবিক শক্তি ও অস্ত্রের ক্ষমতাসম্পন্ন ভারত, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্্েরর মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্পর্ক পুরামাত্রায় বহাল রয়েছে। এগুলো জানা জিনিস। কিন্তু সামরিক শক্তির অবস্থা ও ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটছে সেইসবও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। যেমন : নৌ বাহিনীর শক্তি বা সমুদ্রের ওপর দখলদারি ও সামরিক আধিপত্য বজায় রাখবার শক্তি। সামরিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য দিকও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। হিলারি কিনটনের এই সফরের মাত্র কিছুদিন আগে ভারত দূর পাল্লার পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বালিস্টিক মিসাইল অগ্নি-৫ সফল ভাবে পরীক্ষা করেছে। নিজের সামরিক ক্ষমতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম সেটা দিল্লী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন উভয়কেই জানান দিল। সুস্পষ্ট ভাবেই সেটা প্রদর্শন করা হোল। এটা হোল হিলারি সফরে আসার আগে এক ধরনের সরব ঘোষণার মতো। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারত বেইজিং ও সাংহাইয়ে পারমাণবিক আক্রমণ চালাতে সক্ষম। যে অল্প কয়েকটি দেশ দূর পাল্লার পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম ভারত এখন তাদের কাবে যোগ দিল। দেশগুলো হচ্ছে চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিবারের সদস্য হোল এখন ভারত। ফলে সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্ন সরল ভাবে আলোচনার বিষয় নয়। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের সম্পর্কের জটিলতাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করাই সুবুদ্ধির লক্ষণ।
চিনে মার্কিন রাষ্ট্রবিষয়ক সেক্রেটারির সঙ্গে থাকবেন তাদের ট্রেজারি সেক্রেটারি টিমথি গ্রেইথনার। তারা এখন সভা করছে উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়াং কিশান এবং রাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা দাই বিনগগু-ওর সঙ্গে। এটা চিন-মার্কিন চতুর্থ সামরিক কৌশল ও অর্থনৈতিক বিষয়ে চতুর্থ দফা পরামর্শ সভা (US- chi na strategic and Economic Dialogue (s & ED)। এই সভা দুই দেশের জন্য যোগাযোগ বাড়ানো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন এবারের সভার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দুই দেশের ‘পুরা সরকার’ (whole of government) এই সভায় অংশগ্রহণ করবে। মন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির প্রতিনিধিরা এখানে থাকবেন। হিলারি আরেকটি খুব উঁচু পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগ দেবেন চিনাদের সঙ্গে। সেটা হচ্ছে ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ’ বাড়াবার পরামর্শ সভা। মার্কিন আর চিনা নাগরিকদের মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা, খেলাধুলা, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল এবং নারী প্রসঙ্গ নিয়ে আরও বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ বাড়াবার পরামর্শ ও পরিকল্পনার জন্য এই সভা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুলান্ড এটাও জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ‘জবরদস্ত’ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিাত চুক্তিও হিলারি ঢাকায় পর্যালোচনা করবেন। তবে সেটা চূড়ান্ত কোন চুক্তিতে পৌঁছাবে কিনা তা জানান নি।
পশ্চিম বাংলার কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন হিলারি। মমতা ক্ষমতায় আসার পর কী উন্নতি ঘটল তার খোঁজখবর নেবেন বলে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া ওবামা প্রশাসনের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর দিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছে তাতে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ছাড়া আরো অনেক সুবিধা তৈরী হয়েছে। মমতা কিভাবে সেইসব কাজে লাগাবেন সেটা সম্ভবত শুনতে চাইবেন হিলারি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বরাত দিয়ে যেসব খবরাখবর শোনা যাচ্ছে তাতে এই ধরনের অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া বিশেষ কিছু এখনো জানা যায় নি। মমতা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কী সুযোগ নিতে চান বা চাইবেন সেটা হিলারি কিনটন জানতে চাইতেই পারেন এবং সেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সাধারণ স্বার্থ নিহিত আছে কিনা সেটা জানা এবং মমতা ব্যানার্জিকে বোঝা তার কাজ। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজ্য হিশাবে পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক এবং সে গতিকে আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়েও মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলবেন হিলারি, এটা স্বাভাবিক। তবু বলা যায়, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক নিয়ে হিলারি-মমতা কথা বলবেন এই রটনা মনে হয় গৌণ। মমতা ভারতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আগামি দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন তিনি। ফলে তার সম্পর্কে এখন থেকেই মার্কিনীদের সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরী একটা কাজ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান প্রতিনিধির এটাই আসল কাজ।
চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের সভা করে এসে বাংলাদেশে হিলারি কিনটন চিনের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে নতুন এক প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে আসবেন এটা চিন্তা করতে অনেক বেশি কল্পনা শক্তির দরকার হয়। বিপজ্জনক হোল নতুন করে বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীনে আনবার প্রয়োজনীয়তা যে নাই এই দিকটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। ভুলছি কারণ শেখ হাসিনা ও মনমোহনের দিল্লী ঘোষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে করিডোর দেবার চুক্তির মর্ম বুঝবার অক্ষমতা। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেইমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট মূলত একটি সামরিক ও নিরাপত্তামূলক চুক্তি। এই চুক্তির পর এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবার পর শেখ হাসিনার সরকারকে নতুন করে মার্কিন-ভারত ও ইসরায়েলের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের পাহারাদার প্রমাণ করা অপ্রয়োজনীয়। এই বিষয়ে আমি এর আগে লিখেছি। (যেমন ‘ভারতের নিরাপত্তা বন্দোবস্ত ও হাসিনা-মনমোহন চুক্তির সামরিক লক্ষ্য’ (নয়া দিগন্ত ৯-১০-২০১০;) “দিল্লীর সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের গোলামি বাংলাদেশের ‘নিয়তি’ হতে পারে না”...ইত্যাদি)। এখানে সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করব না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঠিক কী চুক্তি হয় তা দেখার জন্য আমরা বরং অপেক্ষা করব। তখন নতুন কী যোগ হোল তার বিচার করা যাবে। এখানে হিলারি কিনটন মার্কিন কূটনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কিভাবে আনতে চাইছেন ও আনছেন সেই সম্পর্কে তারই একটি লেখা ধরে দুই একটি কথা বলব।
৩.
হিলারি কিনটনের যে লেখাটির কথা বলছি সেটা ছাপা হয়েছিল Foreign Affairs (November December 2010) পত্রিকায় লেখাটির শিরোনাম, ‘বেসামরিক শক্তির জোরে নেতৃত্ব রাখা : মার্কিন কূটনীতি ও উন্নয়ন কৌশলের পুনর্বিবেচনা’ (Leading Through Civilian power : Redefining Amercan diplomacy and Development)। হিলারি বলছেন, এই কালে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (সাম্রাজ্যবাদী) নেতৃত্ব বহাল রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্মার্ট বা চৌকস হতে হবে। এর নাম তিনি দিয়েছেন ‘স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ’। বিশ্বের সংকটকে তিনি সাজিয়েছেন সন্ত্রাস-বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা-জলবায়ুর পরিবর্তন এবং দারিদ্র-এই ভাবে পরপর। বিশ্বে ক্ষমতা আর এক কেন্দ্রিক নয়, ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এই পরিস্থিতি সকলকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সেটা কঠিন কাজ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক শক্তিকে সংগঠিত করতে হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি রবার্ট গেইটস যেভাবে বলেছেন হিলারি কিনটনও তাকে সমর্থন করেই বলেছেন বেসামরিক শক্তির সঙ্গে সামরিক শক্তির সঙ্গে আরো ভাল সমন্বয় ঘটাতে হবে। মার্কিন বেসামরিক সংস্থা যেমন পররাষ্ট্র দফতর ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (United States Agency for International Development সংক্ষেপে USAID) প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদেরকে আরো নেতৃত্ব দেবার ভূমিকায় নিয়ে আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ায় তার সম্রাজ্যবাদী নেতৃত্ব বজায় রাখতে হলে শুধু সামরিক শক্তির নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র দফতরের কূটনীতি ও মার্কিন সাহায্য সংস্থাকেও যার যার ক্ষেত্রে নেতৃত্বদান কারী ভূমিকা পালন করতে হবে। তার মানে সমরনীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতি এই তিন ক্ষেত্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোকেও সমান তালে সমান মাত্রায় নেতৃত্ব দিতে হবে। এর জন্য লোকবল ও অর্থবল বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ইউএসএইডকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নতুন করে সাজাবার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এটি পৃথিবীর সেরা উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়। এর জন্য মার্কিন লোকজন নিয়োগ করা ছাড়াও বিভিন্ন দেশে স্থানীয় ভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যেন মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় তার ওপর হিলারি জোর দিয়েছেন। নিজের দেশের সম্পর্কে তাদেরই গভীর জ্ঞান আছে। উদাহরণ হিশাবে বলা যায়, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে যারা মার্কিন দূতাবাস কিম্বা মার্কিন সাহায্য সংস্থায় কাজ করবে তাদেরকে আরও ভাল ভাবে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। তারাই বাংলাদেশকে ভাল চেনে ও জানে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বহাল রাখবার জন্য এটা হচ্ছে স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ। এটা নতুন জিনিস।
এই এপ্রোচ মনে রেখে হিলারি কিনটন ২০০৯ সালের দিকে পররাষ্ট্র দফতর ও মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার আমূল সংস্কার ও কাজ করবার ধরনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন এবং সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কাজের ধরনে যে পরিবর্তন ঘটেছে সংক্ষেপে তার কয়েকটি দিক তুলে ধরছি যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এক. কূটনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন তৎপরতাকে কাজ করতে হবে সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি এবং সামরিক তৎপরতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে।
দুই. কূটনীতি এতোকাল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চর্চা হোত। কিন্তু এখন সেটা আর হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ ও উন্নয়ন সংস্থা একটি দেশের সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিভাগ ছাড়াও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দল, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন ও মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবেন।
মার্কিন দূতাবাস ও মার্কিন দূতের ভূমিকা এই কাজ করবার জন্য দক্ষ হতে হবে এবং কূটনীতির পুরানা ধ্যানধারণা বাদ দিতে হবে। নিজেদেরকেও বদলাতে হবে।
তিন. দুনিয়া জুড়ে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে তার কারণে সরকারের বাইরে নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেসব ইস্যু আগে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে মনে করা হোত এখন তাকে সেভাবে দেখলে চলবে না। যেমন অর্থনৈতিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও নীতি, ওষুধ ও অসুখ, সংগঠিত অপরাধ, ুধা ইত্যাদি। স্বাস্থ্য কৃষি গরিবী মোচনের মতো কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
চার. সরাসরি একটি দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে এই কারণে যে যারা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে সক্রিয় (non state actor), বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনগণকে আগের চেয়ে তারা আরও অনেক দ্রুত গতিতে প্রভাবিত করতে সক্ষম। হিলারি কিনটন নন স্টেইট এক্টর বলতে মূলত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াকু রাজনৈতিক গোষ্ঠি যেমন মাওবাদি বা সশস্ত্র বামপন্থি দল এবং মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইসলামপন্থি দল বা শক্তির কথাই বলছেন। যেসব বামপন্থি মানব বন্ধনের মতো কর্মসূচী দিয়ে বিপ্লবের দায় সারছেন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কোন হুমকি নয়। তারা সুশীল সমাজেরই অংশ, সেই হিশাবে মিত্র।
পাঁচ. হিলারি পরিষ্কারই বলছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ‘সুশীল সমাজ’ তৈরি ও তাদের বিস্তার ঘটানোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করবার সঠিক নিরাপত্তা কৌশল।
বলা বাহুল্য, মার্কিন সামরিক নীতির সাথে কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতির সমন্বয় ঘটাবার মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে হিলারি কিনটন দেশে দেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন তার আরও বিশ্লেষণ দরকার এবং বাংলাদেশে তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার ওপর নজরদারি নিবদ্ধ রাখা খুবই জরুরি। আজ তার সুযোগ হবে না।
এতটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে বাংলাদেশে হিলারি কিনটনের সফরের অর্থ বোঝার জন্য শুধু সরকারি পর্যায়ে কী চুক্তি হতে যাচ্ছে সেই দিকে নজর রাখলে চলছে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কূটনীতির চর্চার নীতি পরিহার করেছে সেটা তো তারা লিখেই জানান দিচ্ছে সারা দুনিয়ায়। এটা গোপন কিছু নয়।
শেখ হাসিনা বা বেগম খালেদার সাথে সাক্ষাতেরও তাৎপর্যও এই পরিপ্রেক্ষিতে গৌন। বরং বাংলাদেশে হিলারি যে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সাথে দেখা করবেন সেটাই হবে তার সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। সেটা দেখা ও বোঝার অপেক্ষায় রইলাম।
farhadmazhar@hotmail.com
৪ মে ২০১২। ২৫ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।
১.
হিলারি কিনটন শুধু বাংলাদেশে আসছেন না। প্রথমত তিনি আসছেন চিন থেকে। তারপর তিনি আসবেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে যাবেন ভারতে। কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন। তাঁর বাংলাদেশ সফরকে দিল্লী-ঢাকা-ওয়াশিংটন মিলে চিনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার সফর হিশাবে দেখতে চাইছেন অনেকে। এটা খুবই সরল ভাবে দেখা। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং ভাঙন বেসামাল হয়ে পড়ছে প্রায়ই। এর কারণে শক্তিশালী দেশগুলোর সামরিক ও নিরাপত্তা ভাবনা নতুন বাস্তবতায় বদলাচ্ছে। এর রূপ ঠিক কী দাঁড়াবে সেটা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাও আগের মতো তীব্র নয় এবং এই বৈরিতা চিরস্থায়ী হবে সেটাও আগাম অনুমান করা অসম্ভব। এটা ঠিক যে নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ টিকিয়ে রাখবার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। সন্দেহ নাই, সেই ক্ষেত্রে চিনকে সামাল দেওয়ার একটা চিন্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারতের আছে। শুধু এই দিকে নজর নিবদ্ধ রাখলে মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কের নীতিগত ও কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটছে কিনা সেটা আমরা ধরতে পারব না। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন একতরফা ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছেড়ে দেবে, এটা ভাবাও ঠিক নয়। ফলে এই তিনটি দেশের স্বার্থের ঐক্য এবং বিরোধ দুটো দিকই নজরে রাখা দরকার।
যারা বলছেন, এই সময়ে হিলারি কিনটনের বাংলাদেশে আসা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেবারই নামান্তর, তারা খুব ভুল বলছেন না। বিশেষত এর আগে না আসবার কথা বলে এবং এই বিশেষ অস্থির রাজনৈতিক সময়টা বাংলাদেশে আসার জন্য বেছে নিয়ে হিলারি কিনটন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবাদে সমর্থনই জোগালেন। অথচ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরেও বেগম খালেদা জিয়া বিদেশি মেহমানদের সম্মানে কোন কঠোর কর্মসূচি দিলেন না। তার সঙ্গে হিলারি কিনটন সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাত যেন বেসামাল না হয় সেই ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন অবশ্যই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক উত্থান পতনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়। বিদেশি শক্তিগুলো এই কারণেই রাজনৈতিক সংঘাত সীমা ছাড়িয়ে গেলে বিচলিত হয়। অন্যদিকে দুই পক্ষের এই সংঘাতের সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা গুণগত স্তরে উন্নীত করার চেষ্টাও করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখা যাক কী দাঁড়ায়।
২.
চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। পারমাণবিক শক্তি ও অস্ত্রের ক্ষমতাসম্পন্ন ভারত, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্্েরর মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্পর্ক পুরামাত্রায় বহাল রয়েছে। এগুলো জানা জিনিস। কিন্তু সামরিক শক্তির অবস্থা ও ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটছে সেইসবও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। যেমন : নৌ বাহিনীর শক্তি বা সমুদ্রের ওপর দখলদারি ও সামরিক আধিপত্য বজায় রাখবার শক্তি। সামরিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য দিকও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। হিলারি কিনটনের এই সফরের মাত্র কিছুদিন আগে ভারত দূর পাল্লার পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বালিস্টিক মিসাইল অগ্নি-৫ সফল ভাবে পরীক্ষা করেছে। নিজের সামরিক ক্ষমতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম সেটা দিল্লী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন উভয়কেই জানান দিল। সুস্পষ্ট ভাবেই সেটা প্রদর্শন করা হোল। এটা হোল হিলারি সফরে আসার আগে এক ধরনের সরব ঘোষণার মতো। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারত বেইজিং ও সাংহাইয়ে পারমাণবিক আক্রমণ চালাতে সক্ষম। যে অল্প কয়েকটি দেশ দূর পাল্লার পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম ভারত এখন তাদের কাবে যোগ দিল। দেশগুলো হচ্ছে চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিবারের সদস্য হোল এখন ভারত। ফলে সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্ন সরল ভাবে আলোচনার বিষয় নয়। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের সম্পর্কের জটিলতাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করাই সুবুদ্ধির লক্ষণ।
চিনে মার্কিন রাষ্ট্রবিষয়ক সেক্রেটারির সঙ্গে থাকবেন তাদের ট্রেজারি সেক্রেটারি টিমথি গ্রেইথনার। তারা এখন সভা করছে উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়াং কিশান এবং রাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা দাই বিনগগু-ওর সঙ্গে। এটা চিন-মার্কিন চতুর্থ সামরিক কৌশল ও অর্থনৈতিক বিষয়ে চতুর্থ দফা পরামর্শ সভা (US- chi na strategic and Economic Dialogue (s & ED)। এই সভা দুই দেশের জন্য যোগাযোগ বাড়ানো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন এবারের সভার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দুই দেশের ‘পুরা সরকার’ (whole of government) এই সভায় অংশগ্রহণ করবে। মন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির প্রতিনিধিরা এখানে থাকবেন। হিলারি আরেকটি খুব উঁচু পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগ দেবেন চিনাদের সঙ্গে। সেটা হচ্ছে ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ’ বাড়াবার পরামর্শ সভা। মার্কিন আর চিনা নাগরিকদের মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা, খেলাধুলা, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল এবং নারী প্রসঙ্গ নিয়ে আরও বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ বাড়াবার পরামর্শ ও পরিকল্পনার জন্য এই সভা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুলান্ড এটাও জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ‘জবরদস্ত’ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিাত চুক্তিও হিলারি ঢাকায় পর্যালোচনা করবেন। তবে সেটা চূড়ান্ত কোন চুক্তিতে পৌঁছাবে কিনা তা জানান নি।
পশ্চিম বাংলার কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন হিলারি। মমতা ক্ষমতায় আসার পর কী উন্নতি ঘটল তার খোঁজখবর নেবেন বলে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া ওবামা প্রশাসনের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর দিয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছে তাতে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ছাড়া আরো অনেক সুবিধা তৈরী হয়েছে। মমতা কিভাবে সেইসব কাজে লাগাবেন সেটা সম্ভবত শুনতে চাইবেন হিলারি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বরাত দিয়ে যেসব খবরাখবর শোনা যাচ্ছে তাতে এই ধরনের অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া বিশেষ কিছু এখনো জানা যায় নি। মমতা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কী সুযোগ নিতে চান বা চাইবেন সেটা হিলারি কিনটন জানতে চাইতেই পারেন এবং সেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সাধারণ স্বার্থ নিহিত আছে কিনা সেটা জানা এবং মমতা ব্যানার্জিকে বোঝা তার কাজ। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজ্য হিশাবে পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক এবং সে গতিকে আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়েও মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলবেন হিলারি, এটা স্বাভাবিক। তবু বলা যায়, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক নিয়ে হিলারি-মমতা কথা বলবেন এই রটনা মনে হয় গৌণ। মমতা ভারতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আগামি দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন তিনি। ফলে তার সম্পর্কে এখন থেকেই মার্কিনীদের সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরী একটা কাজ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান প্রতিনিধির এটাই আসল কাজ।
চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের সভা করে এসে বাংলাদেশে হিলারি কিনটন চিনের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে নতুন এক প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে আসবেন এটা চিন্তা করতে অনেক বেশি কল্পনা শক্তির দরকার হয়। বিপজ্জনক হোল নতুন করে বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীনে আনবার প্রয়োজনীয়তা যে নাই এই দিকটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। ভুলছি কারণ শেখ হাসিনা ও মনমোহনের দিল্লী ঘোষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে করিডোর দেবার চুক্তির মর্ম বুঝবার অক্ষমতা। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেইমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট মূলত একটি সামরিক ও নিরাপত্তামূলক চুক্তি। এই চুক্তির পর এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবার পর শেখ হাসিনার সরকারকে নতুন করে মার্কিন-ভারত ও ইসরায়েলের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের পাহারাদার প্রমাণ করা অপ্রয়োজনীয়। এই বিষয়ে আমি এর আগে লিখেছি। (যেমন ‘ভারতের নিরাপত্তা বন্দোবস্ত ও হাসিনা-মনমোহন চুক্তির সামরিক লক্ষ্য’ (নয়া দিগন্ত ৯-১০-২০১০;) “দিল্লীর সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের গোলামি বাংলাদেশের ‘নিয়তি’ হতে পারে না”...ইত্যাদি)। এখানে সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করব না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঠিক কী চুক্তি হয় তা দেখার জন্য আমরা বরং অপেক্ষা করব। তখন নতুন কী যোগ হোল তার বিচার করা যাবে। এখানে হিলারি কিনটন মার্কিন কূটনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কিভাবে আনতে চাইছেন ও আনছেন সেই সম্পর্কে তারই একটি লেখা ধরে দুই একটি কথা বলব।
৩.
হিলারি কিনটনের যে লেখাটির কথা বলছি সেটা ছাপা হয়েছিল Foreign Affairs (November December 2010) পত্রিকায় লেখাটির শিরোনাম, ‘বেসামরিক শক্তির জোরে নেতৃত্ব রাখা : মার্কিন কূটনীতি ও উন্নয়ন কৌশলের পুনর্বিবেচনা’ (Leading Through Civilian power : Redefining Amercan diplomacy and Development)। হিলারি বলছেন, এই কালে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (সাম্রাজ্যবাদী) নেতৃত্ব বহাল রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্মার্ট বা চৌকস হতে হবে। এর নাম তিনি দিয়েছেন ‘স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ’। বিশ্বের সংকটকে তিনি সাজিয়েছেন সন্ত্রাস-বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা-জলবায়ুর পরিবর্তন এবং দারিদ্র-এই ভাবে পরপর। বিশ্বে ক্ষমতা আর এক কেন্দ্রিক নয়, ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এই পরিস্থিতি সকলকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সেটা কঠিন কাজ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক শক্তিকে সংগঠিত করতে হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি রবার্ট গেইটস যেভাবে বলেছেন হিলারি কিনটনও তাকে সমর্থন করেই বলেছেন বেসামরিক শক্তির সঙ্গে সামরিক শক্তির সঙ্গে আরো ভাল সমন্বয় ঘটাতে হবে। মার্কিন বেসামরিক সংস্থা যেমন পররাষ্ট্র দফতর ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (United States Agency for International Development সংক্ষেপে USAID) প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদেরকে আরো নেতৃত্ব দেবার ভূমিকায় নিয়ে আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ায় তার সম্রাজ্যবাদী নেতৃত্ব বজায় রাখতে হলে শুধু সামরিক শক্তির নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র দফতরের কূটনীতি ও মার্কিন সাহায্য সংস্থাকেও যার যার ক্ষেত্রে নেতৃত্বদান কারী ভূমিকা পালন করতে হবে। তার মানে সমরনীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতি এই তিন ক্ষেত্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোকেও সমান তালে সমান মাত্রায় নেতৃত্ব দিতে হবে। এর জন্য লোকবল ও অর্থবল বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ইউএসএইডকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নতুন করে সাজাবার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এটি পৃথিবীর সেরা উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়। এর জন্য মার্কিন লোকজন নিয়োগ করা ছাড়াও বিভিন্ন দেশে স্থানীয় ভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যেন মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় তার ওপর হিলারি জোর দিয়েছেন। নিজের দেশের সম্পর্কে তাদেরই গভীর জ্ঞান আছে। উদাহরণ হিশাবে বলা যায়, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে যারা মার্কিন দূতাবাস কিম্বা মার্কিন সাহায্য সংস্থায় কাজ করবে তাদেরকে আরও ভাল ভাবে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। তারাই বাংলাদেশকে ভাল চেনে ও জানে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বহাল রাখবার জন্য এটা হচ্ছে স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ। এটা নতুন জিনিস।
এই এপ্রোচ মনে রেখে হিলারি কিনটন ২০০৯ সালের দিকে পররাষ্ট্র দফতর ও মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার আমূল সংস্কার ও কাজ করবার ধরনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন এবং সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কাজের ধরনে যে পরিবর্তন ঘটেছে সংক্ষেপে তার কয়েকটি দিক তুলে ধরছি যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এক. কূটনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন তৎপরতাকে কাজ করতে হবে সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি এবং সামরিক তৎপরতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে।
দুই. কূটনীতি এতোকাল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চর্চা হোত। কিন্তু এখন সেটা আর হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ ও উন্নয়ন সংস্থা একটি দেশের সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিভাগ ছাড়াও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দল, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন ও মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবেন।
মার্কিন দূতাবাস ও মার্কিন দূতের ভূমিকা এই কাজ করবার জন্য দক্ষ হতে হবে এবং কূটনীতির পুরানা ধ্যানধারণা বাদ দিতে হবে। নিজেদেরকেও বদলাতে হবে।
তিন. দুনিয়া জুড়ে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে তার কারণে সরকারের বাইরে নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেসব ইস্যু আগে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে মনে করা হোত এখন তাকে সেভাবে দেখলে চলবে না। যেমন অর্থনৈতিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও নীতি, ওষুধ ও অসুখ, সংগঠিত অপরাধ, ুধা ইত্যাদি। স্বাস্থ্য কৃষি গরিবী মোচনের মতো কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
চার. সরাসরি একটি দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে এই কারণে যে যারা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে সক্রিয় (non state actor), বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনগণকে আগের চেয়ে তারা আরও অনেক দ্রুত গতিতে প্রভাবিত করতে সক্ষম। হিলারি কিনটন নন স্টেইট এক্টর বলতে মূলত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াকু রাজনৈতিক গোষ্ঠি যেমন মাওবাদি বা সশস্ত্র বামপন্থি দল এবং মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইসলামপন্থি দল বা শক্তির কথাই বলছেন। যেসব বামপন্থি মানব বন্ধনের মতো কর্মসূচী দিয়ে বিপ্লবের দায় সারছেন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কোন হুমকি নয়। তারা সুশীল সমাজেরই অংশ, সেই হিশাবে মিত্র।
পাঁচ. হিলারি পরিষ্কারই বলছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ‘সুশীল সমাজ’ তৈরি ও তাদের বিস্তার ঘটানোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করবার সঠিক নিরাপত্তা কৌশল।
বলা বাহুল্য, মার্কিন সামরিক নীতির সাথে কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতির সমন্বয় ঘটাবার মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে হিলারি কিনটন দেশে দেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন তার আরও বিশ্লেষণ দরকার এবং বাংলাদেশে তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার ওপর নজরদারি নিবদ্ধ রাখা খুবই জরুরি। আজ তার সুযোগ হবে না।
এতটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে বাংলাদেশে হিলারি কিনটনের সফরের অর্থ বোঝার জন্য শুধু সরকারি পর্যায়ে কী চুক্তি হতে যাচ্ছে সেই দিকে নজর রাখলে চলছে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কূটনীতির চর্চার নীতি পরিহার করেছে সেটা তো তারা লিখেই জানান দিচ্ছে সারা দুনিয়ায়। এটা গোপন কিছু নয়।
শেখ হাসিনা বা বেগম খালেদার সাথে সাক্ষাতেরও তাৎপর্যও এই পরিপ্রেক্ষিতে গৌন। বরং বাংলাদেশে হিলারি যে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সাথে দেখা করবেন সেটাই হবে তার সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। সেটা দেখা ও বোঝার অপেক্ষায় রইলাম।
farhadmazhar@hotmail.com
৪ মে ২০১২। ২৫ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।