শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

হিলারি কিনটনের স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ

হিলারি কিনটনের স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ


॥ ফরহাদ মজহার ॥

১.
হিলারি কিনটন শুধু বাংলাদেশে আসছেন না। প্রথমত তিনি আসছেন চিন থেকে। তারপর তিনি আসবেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে যাবেন ভারতে। কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন। তাঁর বাংলাদেশ সফরকে দিল্লী-ঢাকা-ওয়াশিংটন মিলে চিনের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলার সফর হিশাবে দেখতে চাইছেন অনেকে। এটা খুবই সরল ভাবে দেখা। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং ভাঙন বেসামাল হয়ে পড়ছে প্রায়ই। এর কারণে শক্তিশালী দেশগুলোর সামরিক ও নিরাপত্তা ভাবনা নতুন বাস্তবতায় বদলাচ্ছে। এর রূপ ঠিক কী দাঁড়াবে সেটা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। চিনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাও আগের মতো তীব্র নয় এবং এই বৈরিতা চিরস্থায়ী হবে সেটাও আগাম অনুমান করা অসম্ভব। এটা ঠিক যে নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ টিকিয়ে রাখবার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। সন্দেহ নাই, সেই ক্ষেত্রে চিনকে সামাল দেওয়ার একটা চিন্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারতের আছে। শুধু এই দিকে নজর নিবদ্ধ রাখলে মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কের নীতিগত ও কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটছে কিনা সেটা আমরা ধরতে পারব না। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন একতরফা ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছেড়ে দেবে, এটা ভাবাও ঠিক নয়। ফলে এই তিনটি দেশের স্বার্থের ঐক্য এবং বিরোধ দুটো দিকই নজরে রাখা দরকার।
যারা বলছেন, এই সময়ে হিলারি কিনটনের বাংলাদেশে আসা শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেবারই নামান্তর, তারা খুব ভুল বলছেন না। বিশেষত এর আগে না আসবার কথা বলে এবং এই বিশেষ অস্থির রাজনৈতিক সময়টা বাংলাদেশে আসার জন্য বেছে নিয়ে হিলারি কিনটন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিবাদে সমর্থনই জোগালেন। অথচ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার পরেও বেগম খালেদা জিয়া বিদেশি মেহমানদের সম্মানে কোন কঠোর কর্মসূচি দিলেন না। তার সঙ্গে হিলারি কিনটন সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংঘাত যেন বেসামাল না হয় সেই ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন অবশ্যই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক উত্থান পতনের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়। বিদেশি শক্তিগুলো এই কারণেই রাজনৈতিক সংঘাত সীমা ছাড়িয়ে গেলে বিচলিত হয়। অন্যদিকে দুই পক্ষের এই সংঘাতের সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একটা গুণগত স্তরে উন্নীত করার চেষ্টাও করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখা যাক কী দাঁড়ায়।

২.
চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। পারমাণবিক শক্তি ও অস্ত্রের ক্ষমতাসম্পন্ন ভারত, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্্েরর মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি ও সম্পর্ক পুরামাত্রায় বহাল রয়েছে। এগুলো জানা জিনিস। কিন্তু সামরিক শক্তির অবস্থা ও ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটছে সেইসবও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। যেমন : নৌ বাহিনীর শক্তি বা সমুদ্রের ওপর দখলদারি ও সামরিক আধিপত্য বজায় রাখবার শক্তি। সামরিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য দিকও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। হিলারি কিনটনের এই সফরের মাত্র কিছুদিন আগে ভারত দূর পাল্লার পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন বালিস্টিক মিসাইল অগ্নি-৫ সফল ভাবে পরীক্ষা করেছে। নিজের সামরিক ক্ষমতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম সেটা দিল্লী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন উভয়কেই জানান দিল। সুস্পষ্ট ভাবেই সেটা প্রদর্শন করা হোল। এটা হোল হিলারি সফরে আসার আগে এক ধরনের সরব ঘোষণার মতো। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারত বেইজিং ও সাংহাইয়ে পারমাণবিক আক্রমণ চালাতে সক্ষম। যে অল্প কয়েকটি দেশ দূর পাল্লার পারমাণবিক হামলা চালাতে সক্ষম ভারত এখন তাদের কাবে যোগ দিল। দেশগুলো হচ্ছে চিন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিবারের সদস্য হোল এখন ভারত। ফলে সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্ন সরল ভাবে আলোচনার বিষয় নয়। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের সম্পর্কের জটিলতাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করাই সুবুদ্ধির লক্ষণ। 
চিনে মার্কিন রাষ্ট্রবিষয়ক সেক্রেটারির সঙ্গে থাকবেন তাদের ট্রেজারি সেক্রেটারি টিমথি গ্রেইথনার। তারা এখন সভা করছে উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়াং কিশান এবং রাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা দাই বিনগগু-ওর সঙ্গে। এটা চিন-মার্কিন চতুর্থ সামরিক কৌশল ও অর্থনৈতিক বিষয়ে চতুর্থ দফা পরামর্শ সভা (US- chi na strategic and Economic Dialogue (s & ED)। এই সভা দুই দেশের জন্য যোগাযোগ বাড়ানো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন এবারের সভার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দুই দেশের ‘পুরা সরকার’ (whole of government) এই সভায় অংশগ্রহণ করবে। মন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির প্রতিনিধিরা এখানে থাকবেন। হিলারি আরেকটি খুব উঁচু পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগ দেবেন চিনাদের সঙ্গে। সেটা হচ্ছে ‘জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ’ বাড়াবার পরামর্শ সভা। মার্কিন আর চিনা নাগরিকদের মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা, খেলাধুলা, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল এবং নারী প্রসঙ্গ নিয়ে আরও বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ বাড়াবার পরামর্শ ও পরিকল্পনার জন্য এই সভা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুলান্ড এটাও জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ‘জবরদস্ত’ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিাত চুক্তিও হিলারি ঢাকায় পর্যালোচনা করবেন। তবে সেটা চূড়ান্ত কোন চুক্তিতে পৌঁছাবে কিনা তা জানান নি।
পশ্চিম বাংলার কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করবেন হিলারি। মমতা ক্ষমতায় আসার পর কী উন্নতি ঘটল তার খোঁজখবর নেবেন বলে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া ওবামা প্রশাসনের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবর দিয়েছে। 
বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছে তাতে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ছাড়া আরো অনেক সুবিধা তৈরী হয়েছে। মমতা কিভাবে সেইসব কাজে লাগাবেন সেটা সম্ভবত শুনতে চাইবেন হিলারি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বরাত দিয়ে যেসব খবরাখবর শোনা যাচ্ছে তাতে এই ধরনের অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া বিশেষ কিছু এখনো জানা যায় নি। মমতা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কী সুযোগ নিতে চান বা চাইবেন সেটা হিলারি কিনটন জানতে চাইতেই পারেন এবং সেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সাধারণ স্বার্থ নিহিত আছে কিনা সেটা জানা এবং মমতা ব্যানার্জিকে বোঝা তার কাজ। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজ্য হিশাবে পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক এবং সে গতিকে আঞ্চলিক সম্পর্ক নিয়েও মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলবেন হিলারি, এটা স্বাভাবিক। তবু বলা যায়, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সম্পর্ক নিয়ে হিলারি-মমতা কথা বলবেন এই রটনা মনে হয় গৌণ। মমতা ভারতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আগামি দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন তিনি। ফলে তার সম্পর্কে এখন থেকেই মার্কিনীদের সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরী একটা কাজ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান প্রতিনিধির এটাই আসল কাজ। 
চিনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের সভা করে এসে বাংলাদেশে হিলারি কিনটন চিনের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ নিয়ে নতুন এক প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে আসবেন এটা চিন্তা করতে অনেক বেশি কল্পনা শক্তির দরকার হয়। বিপজ্জনক হোল নতুন করে বাংলাদেশকে ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অধীনে আনবার প্রয়োজনীয়তা যে নাই এই দিকটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। ভুলছি কারণ শেখ হাসিনা ও মনমোহনের দিল্লী ঘোষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে করিডোর দেবার চুক্তির মর্ম বুঝবার অক্ষমতা। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেইমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট মূলত একটি সামরিক ও নিরাপত্তামূলক চুক্তি। এই চুক্তির পর এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবার পর শেখ হাসিনার সরকারকে নতুন করে মার্কিন-ভারত ও ইসরায়েলের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের পাহারাদার প্রমাণ করা অপ্রয়োজনীয়। এই বিষয়ে আমি এর আগে লিখেছি। (যেমন ‘ভারতের নিরাপত্তা বন্দোবস্ত ও হাসিনা-মনমোহন চুক্তির সামরিক লক্ষ্য’ (নয়া দিগন্ত ৯-১০-২০১০;) “দিল্লীর সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের গোলামি বাংলাদেশের ‘নিয়তি’ হতে পারে না”...ইত্যাদি)। এখানে সেসব কথার পুনরাবৃত্তি করব না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঠিক কী চুক্তি হয় তা দেখার জন্য আমরা বরং অপেক্ষা করব। তখন নতুন কী যোগ হোল তার বিচার করা যাবে। এখানে হিলারি কিনটন মার্কিন কূটনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কিভাবে আনতে চাইছেন ও আনছেন সেই সম্পর্কে তারই একটি লেখা ধরে দুই একটি কথা বলব।
৩.
হিলারি কিনটনের যে লেখাটির কথা বলছি সেটা ছাপা হয়েছিল Foreign Affairs (November December 2010) পত্রিকায় লেখাটির শিরোনাম, ‘বেসামরিক শক্তির জোরে নেতৃত্ব রাখা : মার্কিন কূটনীতি ও উন্নয়ন কৌশলের পুনর্বিবেচনা’ (Leading Through Civilian power : Redefining Amercan diplomacy and Development)। হিলারি বলছেন, এই কালে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (সাম্রাজ্যবাদী) নেতৃত্ব বহাল রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্মার্ট বা চৌকস হতে হবে। এর নাম তিনি দিয়েছেন ‘স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ’। বিশ্বের সংকটকে তিনি সাজিয়েছেন সন্ত্রাস-বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা-জলবায়ুর পরিবর্তন এবং দারিদ্র-এই ভাবে পরপর। বিশ্বে ক্ষমতা আর এক কেন্দ্রিক নয়, ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারপরেও এই পরিস্থিতি সকলকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সেটা কঠিন কাজ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক শক্তিকে সংগঠিত করতে হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি রবার্ট গেইটস যেভাবে বলেছেন হিলারি কিনটনও তাকে সমর্থন করেই বলেছেন বেসামরিক শক্তির সঙ্গে সামরিক শক্তির সঙ্গে আরো ভাল সমন্বয় ঘটাতে হবে। মার্কিন বেসামরিক সংস্থা যেমন পররাষ্ট্র দফতর ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (United States Agency for International Development সংক্ষেপে USAID) প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদেরকে আরো নেতৃত্ব দেবার ভূমিকায় নিয়ে আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ায় তার সম্রাজ্যবাদী নেতৃত্ব বজায় রাখতে হলে শুধু সামরিক শক্তির নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র দফতরের কূটনীতি ও মার্কিন সাহায্য সংস্থাকেও যার যার ক্ষেত্রে নেতৃত্বদান কারী ভূমিকা পালন করতে হবে। তার মানে সমরনীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতি এই তিন ক্ষেত্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোকেও সমান তালে সমান মাত্রায় নেতৃত্ব দিতে হবে। এর জন্য লোকবল ও অর্থবল বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ইউএসএইডকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নতুন করে সাজাবার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এটি পৃথিবীর সেরা উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়। এর জন্য মার্কিন লোকজন নিয়োগ করা ছাড়াও বিভিন্ন দেশে স্থানীয় ভাবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যেন মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় তার ওপর হিলারি জোর দিয়েছেন। নিজের দেশের সম্পর্কে তাদেরই গভীর জ্ঞান আছে। উদাহরণ হিশাবে বলা যায়, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে যারা মার্কিন দূতাবাস কিম্বা মার্কিন সাহায্য সংস্থায় কাজ করবে তাদেরকে আরও ভাল ভাবে মার্কিন স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। তারাই বাংলাদেশকে ভাল চেনে ও জানে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বহাল রাখবার জন্য এটা হচ্ছে স্মার্ট পাওয়ার এপ্রোচ। এটা নতুন জিনিস।
এই এপ্রোচ মনে রেখে হিলারি কিনটন ২০০৯ সালের দিকে পররাষ্ট্র দফতর ও মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার আমূল সংস্কার ও কাজ করবার ধরনে পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন এবং সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। কাজের ধরনে যে পরিবর্তন ঘটেছে সংক্ষেপে তার কয়েকটি দিক তুলে ধরছি যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এক. কূটনৈতিক তৎপরতা ও উন্নয়ন তৎপরতাকে কাজ করতে হবে সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি এবং সামরিক তৎপরতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে।
দুই. কূটনীতি এতোকাল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চর্চা হোত। কিন্তু এখন সেটা আর হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ ও উন্নয়ন সংস্থা একটি দেশের সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিভাগ ছাড়াও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দল, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন ও মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবেন।
মার্কিন দূতাবাস ও মার্কিন দূতের ভূমিকা এই কাজ করবার জন্য দক্ষ হতে হবে এবং কূটনীতির পুরানা ধ্যানধারণা বাদ দিতে হবে। নিজেদেরকেও বদলাতে হবে।
তিন. দুনিয়া জুড়ে যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে গুণগত পরিবর্তন হয়েছে তার কারণে সরকারের বাইরে নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেসব ইস্যু আগে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে মনে করা হোত এখন তাকে সেভাবে দেখলে চলবে না। যেমন অর্থনৈতিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও নীতি, ওষুধ ও অসুখ, সংগঠিত অপরাধ, ুধা ইত্যাদি। স্বাস্থ্য কৃষি গরিবী মোচনের মতো কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
চার. সরাসরি একটি দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে এই কারণে যে যারা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের বাইরে সক্রিয় (non state actor), বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনগণকে আগের চেয়ে তারা আরও অনেক দ্রুত গতিতে প্রভাবিত করতে সক্ষম। হিলারি কিনটন নন স্টেইট এক্টর বলতে মূলত পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াকু রাজনৈতিক গোষ্ঠি যেমন মাওবাদি বা সশস্ত্র বামপন্থি দল এবং মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইসলামপন্থি দল বা শক্তির কথাই বলছেন। যেসব বামপন্থি মানব বন্ধনের মতো কর্মসূচী দিয়ে বিপ্লবের দায় সারছেন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আদৌ কোন হুমকি নয়। তারা সুশীল সমাজেরই অংশ, সেই হিশাবে মিত্র।
পাঁচ. হিলারি পরিষ্কারই বলছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ‘সুশীল সমাজ’ তৈরি ও তাদের বিস্তার ঘটানোই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করবার সঠিক নিরাপত্তা কৌশল।
বলা বাহুল্য, মার্কিন সামরিক নীতির সাথে কূটনীতি ও উন্নয়ন নীতির সমন্বয় ঘটাবার মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে হিলারি কিনটন দেশে দেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন তার আরও বিশ্লেষণ দরকার এবং বাংলাদেশে তা কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার ওপর নজরদারি নিবদ্ধ রাখা খুবই জরুরি। আজ তার সুযোগ হবে না।
এতটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি তাহলে বাংলাদেশে হিলারি কিনটনের সফরের অর্থ বোঝার জন্য শুধু সরকারি পর্যায়ে কী চুক্তি হতে যাচ্ছে সেই দিকে নজর রাখলে চলছে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কূটনীতির চর্চার নীতি পরিহার করেছে সেটা তো তারা লিখেই জানান দিচ্ছে সারা দুনিয়ায়। এটা গোপন কিছু নয়।
শেখ হাসিনা বা বেগম খালেদার সাথে সাক্ষাতেরও তাৎপর্যও এই পরিপ্রেক্ষিতে গৌন। বরং বাংলাদেশে হিলারি যে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সাথে দেখা করবেন সেটাই হবে তার সফরে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। সেটা দেখা ও বোঝার অপেক্ষায় রইলাম। 
farhadmazhar@hotmail.com
৪ মে ২০১২। ২৫ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

মানবাধিকার ও হরতাল বিরোধিতার রাজনীতি



২০১২-০৪-২৬

১. 
মানুষকে ‘গুম’ করে ফেলার অপরাধ মানবাধিকারের চরম লংঘন। রাষ্ট্র নাগরিকদের রক্ষা করবার কথা, কিন্তু রাষ্ট্রই নাগরিকদের ‘গুম’ করে ফেলছে। যে ‘গুম’ হয়ে যাচ্ছে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না, কিম্বা কিছু দিন পর তার লাশ আবিষ্কৃত হচ্ছে। এই অপরাধের বিরুদ্ধে বিএনপির ডাকা হরতালের ইতিবাচক দিক হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার লড়াই জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে পরিণত হবার সম্ভাবনা এই প্রথম বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। হরতাল বা কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে যেভাবে চতুর্দিকে প্রচার চলছে সেই প্রচারের রাজনৈতিক চরিত্র বোঝা এখন একটা জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
‘গুম’ হয়ে যাওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনসারকে সরকার এখনও উদ্ধার করতে সক্ষম হয় নি। প্রকাশ্যে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির তিন দিনের হরতালও সাময়িক শেষ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনসারকে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য সরকারকে আগামি ২৮ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে মানুষ পুড়ে মরেছে, পুলিশের গুলিতে বিশ্বনাথে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কতজন তার হিশাব নাই। তা ছাড়া হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এই দুর্ভোগ সাধারণ মানুষকে পোহাতে হবে। সরকারকে যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেই সময়সীমার মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারকে যদি পাওয়া না যায় তাহলে এরপর কী ঘটবে তা এখনই আন্দাজ করা কঠিন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন ঘটবার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কারণ ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরেও সমাজে রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে গুণগত পরিবর্তনের বিশেষ কোন লক্ষণ আমরা দেখছি না। রাষ্ট্রের যে গভীর অসুখ আমরা দেখছি তা নিরাময়ের পথ কী হতে পারে তা নিয়ে সমাজে বিশেষ কোন ভাবনাচিন্তা নাই। বরং হরতালের বিরোধিতাই দেখছি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হরতাল বা কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচির বিরোধিতা করার অর্থ তাহলে আমাদের বিচার করে দেখা দরকার।
ঠিক যে মানবাধিকার রক্ষার লড়াই জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে পরিণত হবে কি না সেটা আমরা বাংলাদেশের আগামি দিনগুলোতে দেখব। আমরা সম্ভাবনার কথা বলছি কেবল। এই লড়াইকে বিকশিত করা এবং তাতে নেতৃত্ব দেবার শক্তি ও যোগ্যতা আমরা অর্জন করেছিÑ এই দাবি করা যাবে না বলেই শুধু সম্ভাবনার কথা বলা। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা দূরের কথা, মানবাধিকারের সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্পর্ক কী এবং কেন মানবাধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গাঠনিক ভিত্তি সেই দিকগুলো আমাদের কাছে এখনো পরিচ্ছন্ন নয়। তবুও সম্ভাবনা দেখছি কেন? দেখছি এ কারণে যে এই সম্পর্ক বিচার নিছকই তত্ত্বগত ব্যাপার নয়, একটি দেশের জনগণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই এই শিক্ষাটা অর্জন করতে পারে। রাজনৈতিক কর্মসূচির গুরুত্ব এখানেই। যদি মানবাধিকার ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিচার আমাদের জাতীয় রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে তাহলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক চর্চার গুণগত রূপান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। 
যে সহজ সূত্র মনে রেখে আমরা আলোচনা করতে পারি তা হচ্ছে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি এবং তা রক্ষা করবার কর্তব্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি। গণতন্ত্র সম্পর্কে এই অতি প্রাথমিক পাঠ আমাদের বিশেষ নাই বললেই চলে। গণতন্ত্র বলতে আমরা নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু বুঝি কি না সন্দেহ। বাংলাদেশে গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক দল ও শক্তি এই কারণে সাংবিধানিক ভাবে একনায়কতন্ত্র ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বহাল রেখে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের ওপর একনায়কী শাসন কায়েম করে রাখতে পারছে। কখনো সেনাপতিরা সামরিক কায়দায় আবার কখনো রাজনীতিবিদরা বেসামরিক কায়দায় গণতন্ত্রের আলখেল্লা গায়ে দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালিয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ফ্যাসিবাদের মধুর স্বাদও তারা আমাদের দিয়েছেন। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েমকেও আমরা এখন ‘গণতন্ত্র’ বলে থাকি। বাংলাদেশে কি এখন ‘গণতন্ত্র’ কায়েম নাই? আছে। কারণ আমরা ভোট দিয়েই তো সরকার গঠন করেছি। ধন্য দেশ!
তবুও আশা কেন? আশা এ কারণে যে আজ না হয় ইলিয়াস আলীর জন্য হরতাল ডাকা হয়েছে, কাল আমরা আজ অবধি যত মানুষ ‘গুম’ হয়েছে, তাদের সকলের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেও পারি। অন্তত বোধ করবার আশা করতে পারি। মানবাধিকারবিরোধী সব শ্রেণী ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার রাজনৈতিক তাগিদ হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে শিখব। কিন্তু সেটা শিখব মানবাধিকার কর্মী হিশাবে নয়, রাজনৈতিক কর্মী হিশাবে। আর আশাটা ঠিক এখানেই।
রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি ও রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তি নাগরিক হয়ে ওঠে। এই ভিত্তির ওপর রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে গঠন করবার লড়াই হচ্ছে বাংলাদেশের এখনকার লড়াই। এটাই এখন গণতান্ত্রিক জনগণের প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। এই রাজনৈতিক উপলব্ধি সঞ্চার খুব সহজ কাজ নয়। অথচ একটু খোলা মনে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব বাংলাদেশে আমরা যে রাষ্ট্রের অধীনে বাস করি সেই রাষ্ট্রে আমরা দাস, নাগরিক নেই। যে কোন নাগরিক এই রাষ্ট্রে ‘গুম’ হয়ে যেতে পারে। ‘গুম’ তো হয়ে যাচ্ছে। নাগরিকদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র বা সরকার চলে না, সেভাবে এই রাষ্ট্র বানানো হয় নি। চলে কতিপয় মাস্তান বা মাফিয়া গোছের সংগঠনের হুকুমে। অথচ তাদের আমরা রাজনৈতিক দল নামে অভিহিত করে আনন্দ বোধ করি। যখন কিছু দুর্বৃত্তের চরিত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে তখন আমরা হৈচৈ শুরু করি। কিন্তু করি আরেক দঙ্গল দুর্বৃত্তকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করবার জন্য। তারপর যখন দেখি যাহা বাহান্ন তাহাই তেপান্ন, তখন বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি। তখন আবার নিজেকে নীতিনিষ্ঠ প্রমাণ করবার জন্য ঘোরতর ভাবে রাজনীতিবিরোধী হয়ে যাই। এখানেই শেষ না। অতঃপর রাজনীতি মাত্রই খারাপ এই গীত গেয়ে অন্যদেরও রাজনীতিবিমুখ করবার তৎপরতায় নেমে পড়ি। এই যখন আমাদের দুর্দশা তখন একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিন হরতাল পালন করা হয়েছে। সেটা কম কথা নয়। এটা তাৎপর্যপূর্ণ।

২.
তবে বিএনপি মানবাধিকার মর্যাদা বুঝে হরতাল ডেকেছে কি না সেটা বিএনপিকেই বোঝাতে হবে। সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের সকল ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নাগরিকদের পক্ষে এই হরতাল নয়, কিম্বা সাধারণ ভাবে ‘গুম’ বা সর্বপ্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধেও এই হরতাল ডাকা হয় নি। ডাকা হয়েছে বিএনপিরই একজন নেতা ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভার আনসারের জন্য। তবে অন্তত বিএনপি তার অন্যান্য দলীয় রাজনৈতিক ইস্যুর চাইতেও ‘গুম’ হবার কারণে হরতাল ডেকে মানবাধিকারকে রাজনৈতিক ভাবে তুলে ধরবার শর্ত তৈরি করেছে।
তবুও ইলিয়াস আলী ও আনসারের জন্য হরতাল ডাকার পক্ষে একদমই যুক্তি নাই, বলা যাবে না। একটি আশার ওপর সেই যুক্তি দাঁড়াতে পারে। এর আগে যারা ‘গুম’ হয়েছে তাদের হয়তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না, কিন্তু আশা আছে যে ইলিয়াস আলী এখনো জীবিত রয়েছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক অবশ্য জোর দিয়েই বলেছেন, তিনি নিশ্চিত যে ইলিয়াস আলী জীবিত। আইনজীবী হিশাবে তিনি সরকারের আরেকটি তৎপরতায় প্রচণ্ড ুব্ধ হয়েছেন। সেটা হোল ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে দশ বছর পুরানা অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা। একটি লোক গুম হয়েছে পুলিশ জানে, কিন্তু এই মামলা গ্রহণ করা হোল কেন? এই সূত্র ধরেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটা ‘গুম’, নিখোঁজ নয়। কারণ এই নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। সরকার জানে, অথচ অস্বীকার করছে। ‘গুম’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশান অনুযায়ী এটা ‘গুম’ হবার ঘটনা। নিখোঁজ বা অন্তর্ধান নয়। ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাদের নামে এই হরতালের যৌক্তিকতা তাহলে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ঠিক যে মানবাধিকার বিএনপির হাতেও ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বারবার। আইনবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে বিএনপির খ্যাতি আছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপির বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নাই, বরং র‌্যাব গঠন করেছে বলে গর্ব আছে। এই সকল কারণে জনগণের বড় একটি অংশ ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হওয়ায় বিুব্ধ হলেও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হরতালে অংশগ্রহণ করে নি বলে মনে হয়েছে। তবুও নিজ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার জন্য বিএনপি হরতালের কর্মসূচি দিলেও, যেহেতু এই কর্মসূচি ‘গুম’ হয়ে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছে, এই হরতালের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিএনপির দলের সংকীর্ণ উদ্দেশ্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
অতএব মানবাধিকারের মর্যাদা রক্ষার জায়গা থেকে এই হরতালকে সমর্থন না করবার কোনো রাজনৈতিক বা মানবিক যুক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু শুরু থেকেই এই হরতালের বিরুদ্ধে একটা প্রবল বিরোধিতা আমরা লক্ষ্য করেছি। ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার কথা আলাদা। বিরোধিতা করেছে সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ। বিরোধিতা করেছে সরকার সমর্থিত ও সংগঠিত ব্যবসায়ী শ্রেণি। বোঝা যাচ্ছে এই সরকারের বিরুদ্ধে কোন কঠোর কর্মসূচি তারা চায় না। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ব্যাপারটা তাদের কাছে বিএনপির একজন রাজনৈতিক নেতার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপার মাত্র। অন্য দিকে এমন অনেকেই আছেন যারা নীতিগত ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনবিরোধী তাদের বড় একটি অংশ এই হরতাল সমর্থন করে নি। তাদের বিরোধিতার যুক্তি হচ্ছে এই হরতাল বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন আঠারো দল ডেকেছে, অতএব এ হরতাল সমর্থন করা মানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থন করা। সম্ভবত তারা একটি রাজনৈতিক কর্মসূচির দলীয় উদ্দেশ্য আর বিশেষ পরিস্থিতিতে কর্মসূচির রাজনৈতিক তাৎপর্যের মধ্যে পার্থক্য করছে না। আমরা এই কারণে তাদের সঙ্গে একমত নই। কিন্তু হরতালের বিরোধিতা করে যারা প্রকারান্তরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তাদের সঙ্গে এদের যেন আমরা একাকার না করে ফেলি।

৩.
বিএনপি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে তখন বিএনপির উদ্দেশ্য একান্তই দলীয়। বিএনপি আগে এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক সেটাই চায়, কারণ তা না হলে নির্বাচনে কারচুপির এবং হেরে যাবার আশঙ্কা আছে তাদের। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করবেন কারণ তা না হলে নির্বাচনে তার অসুবিধা হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই পক্ষের কাছেই নির্বাচনী কৌশল মাত্র, তত্ত্বাবধায়ক তর্ক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার বা মৌলিক গাঠনিক কোন তর্কের বিষয় নয়। সেই ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের কর্মসূচি সমর্থন করা দলীয় সমর্থনই বটে। কিন্তু কারো ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার ঘটনার প্রতিবাদের কর্মসূচির চরিত্র ভিন্ন। বিশেষত যখন ‘গুম’ হওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে, তখন তা রাষ্ট্রের গুরুতর সঙ্কটের দিকে আমাদের নজর নিবদ্ধ করে। নিজের দলের কর্মীর ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপির দলীয় কর্মসূচিও তখন রাষ্ট্রের গাঠনিক চরিত্র নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। এটা পরিষ্কার যে ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নিছক ফৌজদারি অপরাধের বিষয় নয়। রাষ্ট্রই এখানে অপরাধী। বিএনপি চাক বা না চাক ‘গুম’ হওয়ার বিরুদ্ধে যে কোন কর্মসূচি সমাজে রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করবার সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরী করে এবং তা দলীয় সংকীর্ণ উদ্দেশ্য ছাড়িয়ে যায়। কিম্বা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এবারের হরতালের বৈশিষ্ট্য হোল কোন ইসলামী দলকে হরতালে বিশেষ ভাবে তৎপর দেখা যায় নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবার জন্য বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে ক্ষমতাসীনরা এই অভিযোগ করলেও তাদের গলায় জোর ছিল না। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য হরতাল হচ্ছে এই যুক্তিতে হরতালের বিরোধিতা করা কঠিন। মানবাধিকারের প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান থাকার পরেও বিএনপির ডাকা হরতালের পক্ষে থাকা না থাকা নিয়ে যারা দোদুল্যমানতা দেখিয়েছেন তাদের কথা আগে বলেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য এই হরতাল এই যুক্তি তাদেরও থাকতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এর কোন ভিত্তি নাই। এই পরিস্থিতিতে হরতাল প্রশ্নে অবস্থানহীনতা রাজনীতিহীনতারই সমার্থক। এতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রাম এগিয়ে যাবে না, বরং পিছিয়ে পড়বে।
অবস্থান নেবার মানে এই নয় যে বিএনপির পাশাপাশি হরতালের কর্মসূচি দিতে হবে। মোটেও না। হরতালে অংশগ্রহণের কথাও বলছি না। বরং বলছি এই বিশেষ ইস্যুতে হরতালের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। যত নির্বাক বা আড়ালেই থাকি না কোন কোন ইস্যুতে আমরা কী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি তা সমাজের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার নির্ণায়কও বটে। সেই কারণে কথাগুলো বলে রাখা দরকার।

৪.
কিন্তু নানা অজুহাতে যারা হরতালের বিরোধিতা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে তারা আসলে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট শক্তি ও মানবিক অধিকারবিরোধী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখবার জন্যই হরতালের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কর্মসূচির আগে থেকেই প্রচার চালিয়ে আসছে তারা এবং এখনো প্রচার চালাচ্ছে। এই প্রচার আরো জোরেশোরেই চলবে। তারা সচেতন ভাবেই অর্থনৈতিক দুর্ভোগের কথা বলে ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দমন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবার পক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নিরন্তর মতাদর্শিক বয়ান ও যুক্তি তৈরি করছে। এটাই এবারের হরতালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং দিক। হরতাল চাই না, হরতাল ভালো না, হরতাল খারাপÑ এই কেচ্ছা অনবরত শুনতে হচ্ছে আমাদের। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান দুষমন হিশাবে এই ধারার তৎপরতা হরতালের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে খুব স্পষ্ট ভাবেই ফুটে উঠছে।

‘গুম’ করছে রাষ্ট্র তার পরেও এবারের হরতালের বিপক্ষে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তি যেসব যুক্তি হাজির করছে সেটাই বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন উপাদান। বিএনপি ও তার অধীনে জোটভুক্ত দলের রাজনীতির বিরোধিতা দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদের সমর্থক শ্রেণি ও শক্তিকে এখন চিনব না। ক্ষমতাসীন মহাজোটকে প্রকাশ্যে তারা সমর্থনও করতে পারছে না। গত কয়েক বছরে তাদের শাসনের যে নমুনা দেখেছে মানুষ তার জন্য ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়ানো মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিরোধী শ্রেণি ও শক্তিগুলোর পক্ষে এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার পথ কী? ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে যে কোন কঠিন কর্মসূচিÑ বিশেষত হরতালের বিরোধিতা করা। ফ্যাসিবাদের পক্ষের শ্রেণি ও শক্তি ঠিক এই পথটাই বেছে নিয়েছে। তারা হরতালের প্রাণপণ বিরোধিতা করছে। ফ্যাসিবাদের পক্ষের শ্রেণি ও শক্তিকে এখন তাহলে চিনতে হবে তাদের অতিরিক্ত হরতাল বিরোধিতার মধ্যে।
হরতালের বিরোধিতার যুক্তির অভাব নাই। তিন দিনের হরতালে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত চারজন। সহিংসতা ঘটেছে, সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, জনগণকে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এই সময়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাগুলো স্থগিত করতে হয়েছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কাস ও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরপর তিন দিনের হরতালে ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। এসব অভিযোগ সত্য কোন সন্দেহ নাই। তাহলে তো সামরিক শাসক এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ লড়াই সংগ্রাম করে জান ও মালের যে অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়েছিল তা খুবই ভুল কাজ ছিল। এরশাদ ছিল সামরিক সৈরশাসক, তার কোন গণসমর্থন ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে এখন লড়তে হচ্ছে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, শুধু সরকারও নয় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। স্বৈরশাসনের সাথে তার মৌলিক তফাত হচ্ছে ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিপুল গণসমর্থন থাকে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শ্রেণি ও শক্তির জন্য এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

ফ্যাসিবাদের পক্ষে দ্বিতীয় যে যুক্তি দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বার্থের যুক্তি। বলা হচ্ছে হরতালে নাগরিকদের নিজেদের এবং সামগ্রিক ভাবে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষতি হচ্ছে। অতএব, রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম করা যাবে না। মানবিক অধিকার নিশ্চিত করবার জন্য রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাক্সা এবং তার পক্ষে রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণের বিপরীতে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থকে বারবার মুখ্য করে তোলা হচ্ছে। তুলবে। মানুষের ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষার কথা বলে তার সামষ্টিক রাজনৈতিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার তুমুল প্রচারণা চলছে। পত্রপত্রিকায় টেলিভিশানে মানুষ কিভাবে অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই দিকটাকেই প্রচারের মুখ্য বিষয়ে পরিণত করা হচ্ছে। হরতাল যে কতো খারাপ জিনিস তা প্রমাণের ধুম পড়ে গিয়েছে। যার নজির আমরা যে কোন পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশানে দেখতে পারব। 

প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের ক্ষতি হবে না বা হরতালে মানুষের দুর্গতি হচ্ছে না তা নয়। যে কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে ত্যাগ থাকে মানুষের। ব্যক্তিস্বার্থকে সমষ্টির স্বার্থের অধীনে নিয়ে আসার মধ্য দিয়েই রাজনীতি সমষ্টির স্বার্থ হয়ে ওঠে। সমাজে ব্যক্তি হিশাবে আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিরন্তর অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা চলে। সমাজে আমরা এক নই, অনেক। ব্যক্তির কাছে অন্য সব ব্যক্তি বা সমাজ নিজ নিজ ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের উপায় মাত্র। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আমরা ব্যক্তির স্বার্থ নয়, সমষ্টি স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করি। বলাবাহুল্য, দলবাজি নিয়ে কথা বলছি না আমরা। দলবাজিকে যেন আমরা রাজনীতি বলে ভুল না করি। সমাজে ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যক্তি আলাদা, পৃথক, অসম, বিভিন্ন, বিচিত্র ইত্যাদি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আমরা ‘এক’ হয়ে যাই বা সকলের রাজনৈতিক সত্তা সমান এই সত্য মানি ও তা উপলব্ধির চেষ্টা করি। বাংলাদেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে সমষ্টির মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করেছিলেন। ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার যে রাজনীতি সেই রাজনীতি শুধু আমার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করে না, নাগরিক হিশাবে সকলের অধিকার রক্ষা করে। রাজনীতি বা রাজনৈতিক সমাজ হচ্ছে সেই পরিমণ্ডল যেখানে সবার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করা সম্ভব। কিন্তু ফ্যাসিবাদ এখন এই সম্পর্ককেই উল্টিয়ে দিতে চাইছে। মানবাধিকার আদায় ও রক্ষার জন্য কঠোর কোন আন্দোলন-সংগ্রাম করা যাবে না। কোন হরতাল করা যাবে না। কারণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। ব্যক্তি স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থকে রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদ বিদ্যমান রাষ্ট্রকেই শুধু টিকিয়ে রাখতে চাইছে না, একই সাথে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও টিকিয়ে রাখতে চাইছে। ফ্যাসিবাদ বলতে চায়, রাজনৈতিক মুক্তির দরকার নাই, তার জন্য লড়াই-সংগ্রাম আত্মত্যাগ মূল্যহীন, অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষাই আমাদের প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সম্পর্ক উল্টিয়ে দেবার সাফল্যের মাত্রাই ফ্যাসিবাদের আগামি দিনে টিকে থাকা না থাকা নির্ণয় করবে। সামষ্টিক রাজনৈতিক স্বার্থকে অস্বীকার করবার জন্য ব্যক্তি স্বার্থকেই বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদ মহিমান্বিত করে তুলবে। ফ্যাসিবাদের পক্ষে প্রচারের এই ধরনই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। সবচেয়ে বিপজ্জনক। 

আইনবহির্ভূত হত্যা, মানুষ ‘গুম’ করে ফেলা ইত্যাদি অপরাধ বন্ধ করবার জন্য অনেকে রাষ্ট্র যেমন আছে তেমনি র‌্যাব বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিলুপ্ত করে দেবার প্রস্তাব দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থা হিউমেন রাইটস ওয়াচ এই প্রস্তাব দিয়ে আসছে অনেক দিন আগে থেকেই। রাষ্ট্রের কোন সংস্থা দানব হয়ে উঠলে তাকে বিলুপ্ত করা একটা দাবি হতেই পারে, যে কোন অসুখের বাহ্যিক উপসর্গেরও বিধান দরকার। কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের গাঠনিক অসুখ সারবে না এটা নিশ্চিত বলা যায়। আরেকটি সংস্থা বানাবে বর্তমান মানবাধিকার বিরোধী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সেটাও অচিরে আবার দানব হয়ে উঠবে। সমাজে রাজনৈতিক চিন্তার গুণগত পরিবর্তনের লক্ষণ অসুখের বাহ্যিক চিকিৎসায় প্রস্তাবে নাই। নিদেনপক্ষে মানবাধিকার রক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের গাঠনিক সম্পর্ক নিয়ে যে ন্যূনতম উদ্বেগ সমাজে তৈরি হবার কথা, সমাজে তা অনুপস্থিত। ফলে বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতন, দৈহিক ভাবে আটক ব্যক্তিকে অমানুষিক ভাবে নির্যাতন করে তার কাছ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায়, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, আইনবহির্ভূত হত্যা, ‘গুম’ হয়ে যাওয়া ইত্যাদির হাত থেকে আমরা অচিরে নিস্তার পাব এমন আশা করা কঠিন। সঙ্ঘাত, রক্তপাত, দমন-পীড়নের অসহনীয় অত্যাচার তো আছেই। দলীয় মাস্তানির কুৎসিত বলয়ের মধ্যে আমাদের আরো কত দিন ঘুরপাক খেতে হবে কে জানে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একা দায়ী করে নিজেদের পাপ লাঘব করা সহজ। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে সমাজে চিন্তাচেতনার অনাগ্রহ এবং অভাবের দিকেও আমাদের নজর ফেরাতে হবে। এই অনাগ্রহ ও অভাবের কথা মনে রেখেই একটি মানবাধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে তিনদিনের হরতাল পালন ইতিবাচক। হরতালের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী শ্রেণি ও শক্তির প্রচারণার জবাব দেওয়ার জন্য এই কথা জোরের সঙ্গে এখন বলা দরকার। 
ঠিক যে হরতালের কর্মসূচি বিএনপির। কিন্তু রাজনীতি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ব্যাপর মাত্র নয়। একদা একটি আদর্শ রাজনৈতিক দল আকাশ থেকে নেমে আসবে এবং সেই দল আমাদের মুক্তি দেবে, তারপর সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেÑ এই ধরনের আধ্যাত্মিক চিন্তায় মগ্ন থেকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক তৎপরতার প্রতি বিমুখ থাকা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশে খেটে খাওয়া শ্রেণির রাজনীতির দুর্বলতার কারণে এই প্রকার আধ্যাত্মিক প্রবণতা বেড়েছে। যদি আমরা রাজনীতি বা রাজনৈতিক তৎপরতার বিমুখ হয়ে পড়ি তাহলে ফেরেশতা এসেও আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না। রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতা ক্ষতি ছাড়া কোন জনগোষ্ঠির জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে নি। আজ রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাধা হয়ে উঠেছে। এই আধ্যাত্মিকতার ধারকরা বিদ্যমান দুই রাজনৈতিক পক্ষের দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির নজির টেনে রাজনীতি থেকে জনগণকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ থেকে জনগণকে নিরুৎসাহিত করছে। 
আমাদের কাজ হচ্ছে জনগণকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করা। রাজনীতির কোন ইস্যু দলীয় স্বার্থ রক্ষা করে এবং কোন ইস্যু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে জড়িত নিদেনপক্ষে এই ভেদবুদ্ধির বিকাশ ঘটানোর প্রাথমিক কাজগুলো তো আমাদের সম্পন্ন করতে হবে। নয় কি? 
২৫ এপ্রিল ২০১২। ১২ বৈশাখ ১৪১৯। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com