জানুয়ারির ১৯ তারিখে (২০১২) ‘মাঘের পড়ন্ত বিকেলে’ পি এস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাসুদ রাজ্জাক এবং সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল কর্নেল মোহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক ‘সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে’ একটি ‘প্রেস ব্রিফিং’ দিয়েছিলেন বা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। আমি সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ে হাজির ছিলাম না, সে এখতিয়ার আমার নাই। ফলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যারা কথা বলেছেন তাদের মুখে ‘অভ্যুত্থান’ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল কি না বলতে পারব না।
সেখানে তাদের লিখিত বক্তব্যের শিরোনামে ‘অভ্যুত্থান’ শব্দটি নাই। প্রেস ব্রিফিংয়ের শিরোনামে লেখা রয়েছে, “সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপপ্রচার চালানো সম্পর্কিত সেনা সদর দপ্তরের সংবাদ সম্মেলন”। তবে লেখায় কোথাও কোথাও ‘তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থান সংক্রান্ত প্রস্তুতি’, ‘বাংলাদেশে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থান’ ইত্যাদি বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনটি যতটা না ‘অভ্যুত্থান’-সংক্রান্ত ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস সম্পর্কে।
যদি পুরা বিষয়টাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কিছু সদস্যের ‘বিশৃংখলা’র ব্যাপার হয়ে থাকে তাহলে সেটা সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ বিষয়, সেটা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের বিষয় নয়। বিশেষত যখন পি এস পরিদপ্তরের পরিচালক দাবি করেছেন, ‘এই অপপ্রয়াসটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা হয়েছে’। যদি এই ‘বিশৃংখলা’ প্রতিহত হয়েই থাকে তাহলে সংবাদ সম্মেলন বরং নানান সংশয় ও প্রশ্ন তৈরি করেছে এবং রাজনৈতিক জটিলতাকে আরো জটিল করে তুলেছে। তা ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিশাবে পি এস পরিদপ্তরের পরিচালক এই ধরনের সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারেন কি না সেটাও প্রশ্নের বিষয়। একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়, এই বিষয়ে কিছু বলার থাকলে তার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের, সেনাবাহিনীর নয়। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিশাবে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করতে হবে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকেও সমীচীন হতে পারে না।
তবে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার একটা যুক্তি সংবাদ সম্মেলনে সেনাকর্মকর্তারা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, “গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অধীনে থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন সাংগঠনিক ভাবে সুসংগঠিত হয়ে সুনির্দিষ্ট ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আওতায় সমর সরঞ্জাম অর্জন ও সুবিন্যস্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে গুনগত মাপের উচ্চ ধাপে উঠতে সদাব্যস্ত, তখনই ঝেড়ে ফেলা অতীত ইতিহাসের ক্রমধারায় আবারো একটি চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় অতিক্রম করছে। এই সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনাদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা কামনা করছি।”
আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল নয়। প্রধান প্রধান দলের একটিও গণতান্ত্রিক নয়, এটা নতুন কিছু না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচিত সরকার, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার নয়। সেটা তার রাজনৈতিক আচরণেই পরিষ্কার। সরকার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাও এক কথা নয়। বাংলাদেশ কোন অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্র যে বিকট চরিত্র গ্রহণ করেছে তার বিচার ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জনগণ যদি আবার নির্বাচনে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসায় সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপর্যয়। বিএনপি অবশ্য শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ইস্যু করে ক্ষমতায় যাবার পথটাই পরিষ্কার করতে চাইছে। এর মধ্যে ক্ষমতার যাবার উদগ্র সাধ আছে, কিন্তু জনগণের কোন মঙ্গল নাই। এদিকে সেনাবাহিনী নিজেদের পেশাদারির জায়গা বাদ দিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির পরিমণ্ডলে প্রবেশ করছে। ফলে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ধারণাগত বিপত্তি ঘটাচ্ছে শুধু তাকে সমালোচনা করলে চলছে না। রাজনীতিও অস্থির, অস্থিতিশীল ও সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নাগরিক হিশাবে এই সংবাদ সম্মেলনের সমালোচনা এড়িয়ে যাবার উপায় নাই।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে থেকে সেনাবাহিনী ‘গুণগত মানের উচ্চ ধাপে উঠতে সদা ব্যস্ত’। যে ‘অতীত ইতিহাস’ তারা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন সেই ইতিহাসের ক্রমধারায় তারা আরেকটি চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় অতিক্রম করছেন। অর্থাৎ তাঁরা স্পষ্টই আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী পক্ষে দাঁড়িয়ে ‘এই সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়’ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা কামনা করছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘বিশৃংখলা’ না ‘অভ্যুত্থান’-এর জন্য তারা ‘একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল- অর্থাৎ বিএনপিকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন। পুরা বক্তব্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার বলে যে কোন সচেতন নাগরিকের মনে হবে।
বিএনপি, হিযবুত তাহরীর বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুত্থান’-এর সঙ্গে জড়িত আছে কি নাই তার অভিযোগ তোলা, প্রমাণ করা এবং শাস্তি দেবার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের, সেনাবাহিনীর নয়। একে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার দায়ও ক্ষমতাসীনদের। সেনাবাহিনী যদি সেটা প্রতিহত করেই থাকে তাহলে সেনাবাহিনীকে আমরা প্রশংসা করি। এখন সেনা আইনে সেনাবাহিনীর এখতিয়ারের মধ্যে যারা রয়েছে সেই সব দোষীকে ধরা এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করে শাস্তি দেওয়াই সেনাবাহিনীর কাজ। অন্যদের ক্ষেত্রে দায় ক্ষমতাসীন সরকারের। কিন্তু সেনাবাহিনীকে দলীয় প্রচারণার স্বার্থে ব্যবহার করার যে নজির আমরা দেখছি তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক তো বটেই, সেনাবাহিনীর জন্যও বিপজ্জনক। এর ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে যে রাজনৈতিক বিভাজন, অবিশ্বাস ও বিরোধ তৈরি হবে তার মূল্য পুরা দেশকেই দিতে হবে।
‘বিশৃংখলা’ বলতে সেনাসদরের মুখপাত্ররা কী বুঝিয়েছেন? সেটা হচ্ছে ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার প্রয়াস’, ‘রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র বিরোধী কর্মকাণ্ড তথা সেনাবাহিনীকে ‘অপব্যবহার করা’, ‘সেনাবাহিনীর ঘাড়ে ভর করে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থাকে উৎখাতের ঘৃণ্য চক্রান্ত’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’- এইসব। অভিযুক্তরা অপরাধী প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। বলাবাহুল্য ‘বিশৃংখলা’ আর ‘অভ্যুত্থান’ সমার্থক নয়। কিন্তু তর্কটা নিছকই ভাষাতাত্ত্বিক নয়। এই পার্থক্যের মধ্যে ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং সামরিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় প্রতিরক্ষার সম্পর্ক সরাসরি। সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। এই কিস্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সংবিধান সংশোধনী নিয়ে কিছু কথা বলে শেষ করব।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার কিছু দিন আগে বাংলাদেশের সংবিধানের খোলনলচে বদলে দিয়েছে। এই বদলে দেওয়া সংবিধানও যেন কোন সেনা অভ্যুত্থানের (এবং গণ-অভ্যুত্থান) মধ্য দিয়ে কেউ বদলাতে না পারে তার জন্য ৭(ক) ও ৭(খ) নামে দুই বিস্ময়কর অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিভার কোন সীমা-পরিসীমা নাই। তাদের ধারণা আইন করে সেনা অভ্যুত্থান (কিম্বা বা গণ অভ্যুত্থান) ঠেকানো যায়। তাদের দ্বিতীয় প্রতিভাবান ধারণা হচ্ছে অভ্যুত্থান- সেটা সেনাবাহিনী করুক কিম্বা জনগণ করুক- সেটা বুঝি একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির কাজ। সংবিধানের নতুন সংযোজনের লক্ষ্য ‘ব্যক্তি’। অভ্যুত্থান সংবিধান মেনে হয় না। অভ্যুত্থান অনিবার্য কারণেই বিদ্যমান সংবিধানকে বাতিল কিম্বা তার যে কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত, বাতিল বা স্থগিত করে। অতএব বলা হয়েছে,-
“৭ক। সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ।?(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়?(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে,
(২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত? (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে- তাহার এই রূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে”।
সর্বোচ্চ দণ্ড মানে মৃত্যুদণ্ড। সংবিধানের কোন সমালোচনা করা যাবে না। কারণ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সে সমালোচনা সংবিধানের কোন বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় পরাহত করা হয়েছে বলে দোষী হতে হবে। অভ্যুত্থান তো দূরের কথা, এমনকি যদি এই ধরনের সমালোচনাকে অনুমোদন বা অনুসমর্থন করলেও বিপদ। এমনকি এই অনুচ্ছেদ বিচারকদের জন্যও ভীতির কারণ হয়েছে। কোন বিচারক যদি সেই অপরাধকে ‘মার্জনা’ করেন তাহলেও তিনিও ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হবেন এবং তারও সাজা মৃত্যুদণ্ড। সংবিধানে এই ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী অনুচ্ছেদ যুক্ত হওয়ায় যারা ঘোর আওয়ামী দরদি তারাও দারুণ শরম পেয়েছিলেন। তাদের অনেকে লেখালিখি করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারনে একনায়কী শাসক শেখ হাসিনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন এতে সেনা অভ্যুত্থান ঠেকানো দূরের কথা, বরং এতে সেনা অভ্যুত্থানই প্ররোচিত হবে।
যে ‘বিশৃঙ্খলা’-র অপরাধের অভিযোগ সেনাবাহিনী তুলছে যদি তা আসলেই ‘অভ্যুত্থান’ হয়ে থাকে তাহলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। দেখা যাচ্ছে ‘বিশৃংখলা’ এবং ‘অভ্যুত্থান’ নামক শব্দগুলোর পার্থক্য নিছক আক্ষরিক নয়। এর সঙ্গে পঞ্চদশ সংশধোনীর যোগ সরাসরি।
যদি ঘটনা সত্য হয় তাহলে প্রমাণিত হোল পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ঠেকানো যায় নি, যাবেও না। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রয়োগের একটা সুযোগ এখন তৈরি হোল কি না কে জানে!!
শ্যামলী ২৯ জানুয়ারি ২০১২। ১৬ মাঘ ১৪১৮।
ফরহাদ মজহার: কবি, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী
farhadmazhar@hotmail.com