সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

সেনাবাহিনীর নয়, দায় সরকারের

ফরহাদ মজহার

জানুয়ারির ১৯ তারিখে (২০১২) ‘মাঘের পড়ন্ত বিকেলে’ পি এস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাসুদ রাজ্জাক এবং সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল কর্নেল মোহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক ‘সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে’ একটি ‘প্রেস ব্রিফিং’ দিয়েছিলেন বা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। আমি সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ে হাজির ছিলাম না, সে এখতিয়ার আমার নাই। ফলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যারা কথা বলেছেন তাদের মুখে ‘অভ্যুত্থান’ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল কি না বলতে পারব না।

সেখানে তাদের লিখিত বক্তব্যের শিরোনামে ‘অভ্যুত্থান’ শব্দটি নাই। প্রেস ব্রিফিংয়ের শিরোনামে লেখা রয়েছে, “সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপপ্রচার চালানো সম্পর্কিত সেনা সদর দপ্তরের সংবাদ সম্মেলন”। তবে লেখায় কোথাও কোথাও ‘তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থান সংক্রান্ত প্রস্তুতি’, ‘বাংলাদেশে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থান’ ইত্যাদি বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনটি যতটা না ‘অভ্যুত্থান’-সংক্রান্ত ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস সম্পর্কে।

যদি পুরা বিষয়টাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কিছু সদস্যের ‘বিশৃংখলা’র ব্যাপার হয়ে থাকে তাহলে সেটা সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ বিষয়, সেটা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের বিষয় নয়। বিশেষত যখন পি এস পরিদপ্তরের পরিচালক দাবি করেছেন, ‘এই অপপ্রয়াসটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা হয়েছে’। যদি এই ‘বিশৃংখলা’ প্রতিহত হয়েই থাকে তাহলে সংবাদ সম্মেলন বরং নানান সংশয় ও প্রশ্ন তৈরি করেছে এবং রাজনৈতিক জটিলতাকে আরো জটিল করে তুলেছে। তা ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিশাবে পি এস পরিদপ্তরের পরিচালক এই ধরনের সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারেন কি না সেটাও প্রশ্নের বিষয়। একটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়, এই বিষয়ে কিছু বলার থাকলে তার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের, সেনাবাহিনীর নয়। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিশাবে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টা করতে হবে।

সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকেও সমীচীন হতে পারে না।
তবে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার একটা যুক্তি সংবাদ সম্মেলনে সেনাকর্মকর্তারা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, “গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার অধীনে থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন সাংগঠনিক ভাবে সুসংগঠিত হয়ে সুনির্দিষ্ট ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর আওতায় সমর সরঞ্জাম অর্জন ও সুবিন্যস্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে গুনগত মাপের উচ্চ ধাপে উঠতে সদাব্যস্ত, তখনই ঝেড়ে ফেলা অতীত ইতিহাসের ক্রমধারায় আবারো একটি চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় অতিক্রম করছে। এই সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনাদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা কামনা করছি।”

আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল নয়। প্রধান প্রধান দলের একটিও গণতান্ত্রিক নয়, এটা নতুন কিছু না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচিত সরকার, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার নয়। সেটা তার রাজনৈতিক আচরণেই পরিষ্কার। সরকার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাও এক কথা নয়। বাংলাদেশ কোন অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্র যে বিকট চরিত্র গ্রহণ করেছে তার বিচার ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জনগণ যদি আবার নির্বাচনে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসায় সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য আরেক বিপর্যয়। বিএনপি অবশ্য শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ইস্যু করে ক্ষমতায় যাবার পথটাই পরিষ্কার করতে চাইছে। এর মধ্যে ক্ষমতার যাবার উদগ্র সাধ আছে, কিন্তু জনগণের কোন মঙ্গল নাই। এদিকে সেনাবাহিনী নিজেদের পেশাদারির জায়গা বাদ দিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির পরিমণ্ডলে প্রবেশ করছে। ফলে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ধারণাগত বিপত্তি ঘটাচ্ছে শুধু তাকে সমালোচনা করলে চলছে না। রাজনীতিও অস্থির, অস্থিতিশীল ও সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে। নাগরিক হিশাবে এই সংবাদ সম্মেলনের সমালোচনা এড়িয়ে যাবার উপায় নাই।

সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে থেকে সেনাবাহিনী ‘গুণগত মানের উচ্চ ধাপে উঠতে সদা ব্যস্ত’। যে ‘অতীত ইতিহাস’ তারা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন সেই ইতিহাসের ক্রমধারায় তারা আরেকটি চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় অতিক্রম করছেন। অর্থাৎ তাঁরা স্পষ্টই আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী পক্ষে দাঁড়িয়ে ‘এই সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়’ গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা কামনা করছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘বিশৃংখলা’ না ‘অভ্যুত্থান’-এর জন্য তারা ‘একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল- অর্থাৎ বিএনপিকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন। পুরা বক্তব্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার বলে যে কোন সচেতন নাগরিকের মনে হবে।

বিএনপি, হিযবুত তাহরীর বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এই ‘বিশৃংখলা’ বা ‘অভ্যুত্থান’-এর সঙ্গে জড়িত আছে কি নাই তার অভিযোগ তোলা, প্রমাণ করা এবং শাস্তি দেবার দায় ক্ষমতাসীন সরকারের, সেনাবাহিনীর নয়। একে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার দায়ও ক্ষমতাসীনদের। সেনাবাহিনী যদি সেটা প্রতিহত করেই থাকে তাহলে সেনাবাহিনীকে আমরা প্রশংসা করি। এখন সেনা আইনে সেনাবাহিনীর এখতিয়ারের মধ্যে যারা রয়েছে সেই সব দোষীকে ধরা এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করে শাস্তি দেওয়াই সেনাবাহিনীর কাজ। অন্যদের ক্ষেত্রে দায় ক্ষমতাসীন সরকারের। কিন্তু সেনাবাহিনীকে দলীয় প্রচারণার স্বার্থে ব্যবহার করার যে নজির আমরা দেখছি তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক তো বটেই, সেনাবাহিনীর জন্যও বিপজ্জনক। এর ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে যে রাজনৈতিক বিভাজন, অবিশ্বাস ও বিরোধ তৈরি হবে তার মূল্য পুরা দেশকেই দিতে হবে।

‘বিশৃংখলা’ বলতে সেনাসদরের মুখপাত্ররা কী বুঝিয়েছেন? সেটা হচ্ছে ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার প্রয়াস’, ‘রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র বিরোধী কর্মকাণ্ড তথা সেনাবাহিনীকে ‘অপব্যবহার করা’, ‘সেনাবাহিনীর ঘাড়ে ভর করে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থাকে উৎখাতের ঘৃণ্য চক্রান্ত’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’- এইসব। অভিযুক্তরা অপরাধী প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। বলাবাহুল্য ‘বিশৃংখলা’ আর ‘অভ্যুত্থান’ সমার্থক নয়। কিন্তু তর্কটা নিছকই ভাষাতাত্ত্বিক নয়। এই পার্থক্যের মধ্যে ঘটনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং সামরিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় প্রতিরক্ষার সম্পর্ক সরাসরি। সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। এই কিস্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সংবিধান সংশোধনী নিয়ে কিছু কথা বলে শেষ করব।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকার কিছু দিন আগে বাংলাদেশের সংবিধানের খোলনলচে বদলে দিয়েছে। এই বদলে দেওয়া সংবিধানও যেন কোন সেনা অভ্যুত্থানের (এবং গণ-অভ্যুত্থান) মধ্য দিয়ে কেউ বদলাতে না পারে তার জন্য ৭(ক) ও ৭(খ) নামে দুই বিস্ময়কর অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিভার কোন সীমা-পরিসীমা নাই। তাদের ধারণা আইন করে সেনা অভ্যুত্থান (কিম্বা বা গণ অভ্যুত্থান) ঠেকানো যায়। তাদের দ্বিতীয় প্রতিভাবান ধারণা হচ্ছে অভ্যুত্থান- সেটা সেনাবাহিনী করুক কিম্বা জনগণ করুক- সেটা বুঝি একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির কাজ। সংবিধানের নতুন সংযোজনের লক্ষ্য ‘ব্যক্তি’। অভ্যুত্থান সংবিধান মেনে হয় না। অভ্যুত্থান অনিবার্য কারণেই বিদ্যমান সংবিধানকে বাতিল কিম্বা তার যে কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত, বাতিল বা স্থগিত করে। অতএব বলা হয়েছে,-
“৭ক। সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ।?(১) কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায়?(ক) এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে,
(২) কোন ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত? (ক) কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে- তাহার এই রূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। (৩) এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে”।

সর্বোচ্চ দণ্ড মানে মৃত্যুদণ্ড। সংবিধানের কোন সমালোচনা করা যাবে না। কারণ এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সে সমালোচনা সংবিধানের কোন বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় পরাহত করা হয়েছে বলে দোষী হতে হবে। অভ্যুত্থান তো দূরের কথা, এমনকি যদি এই ধরনের সমালোচনাকে অনুমোদন বা অনুসমর্থন করলেও বিপদ। এমনকি এই অনুচ্ছেদ বিচারকদের জন্যও ভীতির কারণ হয়েছে। কোন বিচারক যদি সেই অপরাধকে ‘মার্জনা’ করেন তাহলেও তিনিও ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হবেন এবং তারও সাজা মৃত্যুদণ্ড। সংবিধানে এই ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী অনুচ্ছেদ যুক্ত হওয়ায় যারা ঘোর আওয়ামী দরদি তারাও দারুণ শরম পেয়েছিলেন। তাদের অনেকে লেখালিখি করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারনে একনায়কী শাসক শেখ হাসিনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন এতে সেনা অভ্যুত্থান ঠেকানো দূরের কথা, বরং এতে সেনা অভ্যুত্থানই প্ররোচিত হবে।

যে ‘বিশৃঙ্খলা’-র অপরাধের অভিযোগ সেনাবাহিনী তুলছে যদি তা আসলেই ‘অভ্যুত্থান’ হয়ে থাকে তাহলে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। দেখা যাচ্ছে ‘বিশৃংখলা’ এবং ‘অভ্যুত্থান’ নামক শব্দগুলোর পার্থক্য নিছক আক্ষরিক নয়। এর সঙ্গে পঞ্চদশ সংশধোনীর যোগ সরাসরি।

যদি ঘটনা সত্য হয় তাহলে প্রমাণিত হোল পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা ঠেকানো যায় নি, যাবেও না। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রয়োগের একটা সুযোগ এখন তৈরি হোল কি না কে জানে!!

শ্যামলী ২৯ জানুয়ারি ২০১২। ১৬ মাঘ ১৪১৮।

ফরহাদ মজহার: কবি, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী
                     farhadmazhar@hotmail.com

সরকারের ভারত নীতিই দায়ী

ফরহাদ মজহার

‘Bangladesh has faced dozens of coups, failed or not, in its 40 years. But for an army spokesman to give details of one, on January 19th, was unusual’. – ‘Politics in Bangladesh;
Turbulent House. The army claims to have thwarted a coup’.
ECONOMIST. 20 January 2012.

ব্যর্থ হোক আর না হোক, কয়েক ডজন অভ্যুত্থান গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে গত ১৯ জানুয়ারি তারিখে একজন সেনা মুখপাত্রের এক অভ্যুত্থানের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার (ইকোনমিস্ট, ২০ জানুয়ারি ২০১২)।

গত দিনের এই লেখার প্রথম কিস্তিতে বোঝাতে চেয়েছি ‘বিশৃংখলা’ এবং ‘অভ্যুত্থান আক্ষরিক দিক থেকে সমার্থক নয়, এটা আমরা সহজেই বুঝি। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল গুরুত্ব হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধান ও আইনের দিক থেকে উভয়ের পার্থক্যের তাৎপর্য। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টায় বেসামরিক কেউ জড়িত থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি ঠিকই বলেছেন, ‘সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর পরে সংবিধান ও আদালতের বিরুদ্ধে সংঘটিত এ ধরনের অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল’ (মানবজমিন, ২৯ জানুয়ারি ২০১২)। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী অপরাধীরা সেই ক্ষেত্রে ‘সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত’ হবে, অর্থাৎ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কিছু সময় পরে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস খবর জানায় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি সম্ভবত এই সংবাদ সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শনিবারও প্রধানমন্ত্রী আবার ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। শুক্রবার রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং পরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনিসহ মন্ত্রিসভার আরো অনেক সদস্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করবার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করতে থাকেন। অর্থাৎ সেনাসদরের তরফে সংবাদ সম্মেলনে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তারা সেই অভিযোগটাকেই বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

জানুয়ারির ২০ তারিখে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে দুটো ব্যাপার খোলাসা হয়ে যায়। তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘উঠেছে খালেদা-পুত্রের নাম : ষড়যন্ত্র হলে হাসিনার পাশেই থাকবে দিল্লি’। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হোল, ‘শেখ হাসিনাকে সরানোর চেষ্টা হলে, তাকে সব রকম সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বাংলাদেশ সরকারকেও সেই বার্তা দেওয়া হয়েছে’। শেখ হাসিনার পক্ষে কোন দেশ থাকুক বা না থাকুক গণতান্ত্রিক ভাবে সরকার পরিবর্তনের যে নির্বাচনী নীতি রয়েছে তার বরখেলাফ করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হোলে বিশ্বের সব দেশই নিন্দা করবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ সেনা অভ্যুত্থান আদৌ সমর্থন করবে কি না সন্দেহ। কিন্তু আনন্দবাজার বলছে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাবার চেষ্টা হলে দিল্লি তাকে ‘সবরকম সাহায্য’ করবার সিদ্ধান- নিয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। তার মানে কি এই যে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য দিল্লি সেনাবাহিনী পাঠাবে?

‘সবরকমের সাহায্য বলতে এটাও বোঝায়। দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি আনন্দবাজার খোলাসা করে দিয়েছে সেটা হোল- বাংলাদেশে দিল্লির গোয়েন্দা নজরদারি তীক্ষ্ণ। মূলত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তাতেই সেনা অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিশৃংখলা বা অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেবার ক্ষেত্রে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সহযোগিতা ছিল। তাদের ভাষায়, ‘সেনা অভ্যুত্থান ভেস্তে দেওয়ার পিছনে ভারতের তরফ থেকেও গোয়েন্দা তথ্য ছিল’। বলা হয়েছে, ‘হিজবুত তাহরীর, জামাতে ইসলাম ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একজোট হয়ে কাজ করছে। গোটা ঘটনার মাথা হিসেবে উঠে আসছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের নামও।’ এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা সেটা বিচার করা আমাদের কাজ নয়। তদন্ত চলছে, এই বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে আমাদের নীরব থাকাই সমীচীন। কিন্তু আনন্দবাজারের এই তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে- এই অভিযোগ শুধু বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের নয়। দুই দেশের গোয়েন্দাদেরই যৌথ তথ্য এটা। দুই দেশের গোয়েন্দারা যে একজোট হয়ে কাজ করছে, তারই ভিত্তিতে আনন্দবাজার এই খবর ছেপেছে। আনন্দবাজার পত্রিকার এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সেনাসদর থেকে কোন প্রতিবাদ আমার চোখে পড়ে নি।

এবার যদি পুরা ঘটনা প্রকাশ হবার আগে ফিরে যাই তাহলে দেখব বিডিআর হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং পেশাগত স্বার্থের ক্ষোভের কথা বাদ দিলে সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৎপরতা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অস্তিরতা ও ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির প্রধান কারণ। তা ছাড়া বাংলাদেশ সীমান্তে ক্রমাগত বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন তো আছেই। সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনের পরদিনই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন পরিস্থিতি অনুধাবন করতে আমাদের খুব কাজে আসে।

আমরা জানি, মেজর জিয়াউল হক নিজেকে ৪১ বিএমএ লং কোর্সের একজন অফিসার দাবি করে ফেসবুক ও ইন্টারনেটে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। ফেসবুক ও ইন্টারনেটে প্রচারিত মেজর জিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী তাঁকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা অপহরণ করেছিল। দুই দিন দুই রাত আটক রাখার পর কৌশলে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এটা তাঁর দাবি, কিন্তু ঘটনার জটিলতা এখান থেকেই শুরু। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কোর্স শেষে বদলিকৃত রেজিমেন্টে যোগদানের পথে তিনি অপহৃত হন বলে তিনি তার লেখালিখিতে দাবি করেন। তুলে নেয়ার পর অজ্ঞাত স্থানে রেখে চোখ বেঁধে তাকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার প্রকাশিত বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি পাশের একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যও উপস্থিত ছিল সেখানে। দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাশের রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এমন কিছু তথ্য মেজর জিয়ার কাছে জানতে চেয়েছে, যা একটি স্বাধীন দেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন- সংবেদনশীল বলে মেজর জিয়া তাঁর জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। তার প্রকাশিত লেখায় তিনি আরো বলেন, লে. কর্নেল যায়ীদ, লে. কর্নেল হাসিন ও লে. কর্নেল এহসান ইউসুফ নামে আরো তিন সেনা অফিসারকে গ্রেফতার দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

এই লেখা ইন্টারনেটে ছড়াতে থাকে। দৈনিক আমার দেশ ৩ জানুয়ারি তাদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ঘটনাটির সত্যতা নির্ণয় করবার জন্য তারা সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে ও মেজর জিয়ার লেখায় উল্লিখিত বাসার ঠিকানায় যাবার চেষ্টা করে বিফল হয়। গেটে বসিয়ে রেখে তাদের বলা হয়, সাংবাদিক প্রবেশ নিষেধ। জানানো হয়, ওপরের কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি ছাড়া যাওয়া যাবে না। পত্রিকাটি ২ জানুয়ারি বিকাল ৩টা ৪৭ মিনিটে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগেও মেজর জিয়ার অভিযোগগুলোর সত্যতা জানতে ফোন করে। তখন পত্রিকাটিকে জানানো হয়, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগ থেকে কিছুই বলা যাবে না। সেনা সদর দফতর বা সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতর মেজর জিয়ার বিষয় জানাতে পারবে বলে জানানো হয়।

সেনা অফিসারদের বিনা বিচারে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বন্দি করে রাখা প্রসঙ্গে দৈনিক আমার দেশ সাবেক সেনাকর্মকর্তা এবং এখন সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের কাছে তাঁর মতামতও জানতে চায়। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘১৫০ দিনের বেশি সময় ধরে লে. কর্নেল পদমর্যাদার দুই অফিসার আটক আছেন বলে তিনিও জানতে পেরেছেন। তিনি আরো বলেন, যতটুকু জানি এদের একজন গত ৯ জুলাই ও আরেকজন ১২ জুলাই কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার হন। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিচার শুরু হয়নি। সেনা বিধান অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়া এবং সেই বিধান ও প্রক্রিয়ার অধীনে প্রযোজ্য মানবাধিকার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্টের ৭৫ ধারা অনুযায়ী, অভিযোগের ভিত্তিতে সেনা অফিসারদের গ্রেফতার করা যায়। এ ধারায়ই বলা আছে, গ্রেফতারের ৮ দিনের ভেতর কোর্টমার্শাল গঠন করতে হবে। ৮ দিনের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব না হলে উপযুক্ত কারণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনে। তিনি বলেন, আইনেই বলা আছে, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠন করতে না পারলে আটক ব্যক্তিদের মুক্ত করে দিতে হবে। ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, ১৫০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি। এতে অনুমান করা যায় প্রমাণ করার মতো কোনো অভিযোগ এ অফিসারদের বিরুদ্ধে নেই। প্রমাণের মতো অভিযোগ থাকলে কোর্ট মার্শাল গঠন হয়ে যেত।’

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা সত্যতা নির্ণয়ের এই অভিজ্ঞতা এবং সেনা অফিসারদের গ্রেফতারের পর ১৫০ দিন পেরিয়ে যাবার পরেও কোন কোর্টমার্শাল গঠিত না হওয়া সম্পর্কে ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেনের বক্তব্য প্রতিবেদন হিশাবে প্রকাশ করার পরই গত ৪ জানুয়ারি আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে, ই-মেইলে অপহরণের অভিযোগকারী মেজর জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর আগে তারা কিছু বলেন নি। ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এমআইএসটি থেকে কোর্স সম্পন্ন শেষে বদলিকৃত ইউনিট ৩ই বেঙ্গলে যোগদানের জন্য মেজর জিয়াকে যাবার আদেশ দেয়া হয়। পরে সেনা শৃঙ্খলাপরিপন্থী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে তখন সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়া, ঢাকা সেনানিবাসে সংযুক্তি আদেশ প্রদান করা হয়। এই আদেশ অনুযায়ী মেজর জিয়া সদর দফতর লজিস্টিক এরিয়ায় যোগদান না করে পলাতক রয়েছেন; এই কারণেই সেনা আইন অনুযায়ী এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল যায়ীদ ও লে. কর্নেল হাসিনকেও শৃঙ্খলাপরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে সেনা আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপরই গত ১১ জুলাই ২০১১ তারিখে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। আদালত সুষ্ঠু তদন- শেষে তাঁদের বক্তব্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন এবং উক্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে লে. কর্নেল হাসিনের বিরুদ্ধে ১১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে একটি ফিল্ড জেনারেল কোর্টমার্শাল গঠন করা হয়; তার বিচারকার্যক্রম চলছে। এই বক্তব্যে দেখা যায়, আট দিনের মধ্যে কোর্টমার্শাল গঠনের বিধান পালিত হয়েছে কি না সেই মৌলিক প্রশ্নটা উহ্য। এই বিধান পালিত না হলেও আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পত্রিকায় উল্লিখিত ‘অভিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিচারকার্যক্রম শুরু হয়নি এবং ১৫০ দিন পার হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোর্টমার্শাল গঠন করা সম্ভব হয়নি’ মর্মে প্রকাশিত বক্তব্য সঠিক নয়।

এরপর গত ৫ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের বরাত দিয়ে ‘মেজর জিয়ার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে’ শীর্ষক আইএসপিআরের বক্তব্যের একাংশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন লে. কর্নেল যায়ীদের ছোট ভাই আ. আ. জাবিদ। এক প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি জানান, তার ভাই যায়ীদ পিএসসি, এমডিএস, এসএ, বিএসবিএএ (এমআইএস, টি.আইবিএ)-কে গত ১০ জুলাই ২০১১ তারিখে ছুটিতে থাকা অবস্থায় পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের সরকারি বাসভবন থেকে তুলে নেয়া হয়। তিন-চার দিন পর পরিবারের লোকজন বিষয়টি জানতে পারেন। সেই থেকে প্রায় ছয় মাস বা ১৮০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অদ্যাবধি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো চার্জ বা অভিযোগ আনতে পারে নাই। তাই যায়ীদ সম্পর্কে আইএসপিআরের বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। আ. আ. জাবিদ তার প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলেন, সামরিক কর্মকর্তাকে তদন্তের জন্য আটক করার প্রয়োজন পড়ে না। তাকে শুধুমাত্র লগ এরিয়াতে অ্যাটাচমেন্ট করলেই হয়। একটি কক্ষে বহুসংখ্যক সৈনিক দ্বারা তালাবদ্ধ অবস্থায় কেন লে. কর্নেল যায়ীদকে আটক রাখা হয়েছে- এর ব্যাখ্যা চান তিনি।

পত্রিকায় আমি যেভাবে পড়েছি সেভাবেই বিষয়গুলো হাজির করছি। আমরা দেখছি পুরা ঘটনাঘটনের মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে- এক. সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সক্রিয় ভূমিকা আনন্দবাজার পত্রিকার বক্তব্যের সঙ্গে যার কোন অসঙ্গতি নাই; দুই. সেনা আইনের অধীনে সৈনিকদের সামরিক আদালতে সুবিচার পাবার অধিকার- যা মানবাধিকারের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত এবং তিন. বিচার ছাড়া আটক রাখা এবং আটক রাখার পরেও অভিযুক্তের আত্মীয়-স্বজনদের তা না জানতে দেওয়া বা অস্বীকার করা।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের ভূমিকা শুধু সেনাবাহিনীর উদ্বেগের বিষয় নয়, বাংলাদেশের যেকোন নাগরিকেরই উৎকণ্ঠার বিষয়। গুজব মাত্রই সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষতিকর। দৈনিক আমার দেশ সকল প্রকার গুজব নিরসন করবার জন্যই আসলে সেনাবাহিনীতে কী ঘটছে তা সেনাবাহিনীর কাছেই জানতে চেয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের উৎকণ্ঠা নিরসন করবার জন্য দৈনিক আমার দেশের ভূমিকাকে দমন করবার জন্য প্রথমে যে কাজটি করা হয় সেটা হোল- মামলা। গত ৮ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি খর্ব ও সম্মানহানির অভিযোগ এনে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, প্রকাশক আলহাজ মো: হাসমত আলী ও বিশেষ প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন একজন সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর (অব:) শাহ আলম তালুকদার। মামলায় তার অভিযোগ হচ্ছে- ৩ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘মেজর জিয়াকে নিয়ে রহস্য’ শিরোনামের সংবাদে বলা হয়েছে, মেজর জিয়া সম্পর্কে জানতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে দৈনিক আমার দেশকে বলা হয়, পরিচালক সাহেব মিটিংয়ে আছেন। মেজর জিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয়, ‘মেজর জিয়া সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া যাবে না’। সাবেক এই সেনাকর্মকর্তার দাবি হচ্ছে দৈনিক আমার দেশের এই সংবাদটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও মানহানিকর। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকা অফিস থেকে জানতে চাইলে সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘নিয়ম মোতাবেক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আনুষঙ্গিক দাপ্তরিক কার্য সম্পাদন অনে- অফিসিয়ালি যাবতীয় তথ্য জানানো হবে। মেজর জিয়া সংশ্লিষ্ট কর্মস'লে যোগদান না করায় তাঁর বিরুদ্ধে সেনা আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে’। খেয়াল রাখতে হবে দৈনিক আমার দেশের বিরুদ্ধে মামলা সেনা কর্তৃপক্ষ করছে না, করছে একজন সাবেক সেনা অফিসার। কিন্তু তিনি জানেন সেনা কর্তৃপক্ষ দৈনিক আমার দেশকে কী বলেছে। এখন অভিযোগ হচ্ছে যে- বিবাদিরা তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে আমার দেশ তা উল্লেখ করায় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের সম্মুখীন এবং এতে বাদি একজন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা হওয়ায় তার মর্যাদা/সম্মানহানি হয়েছে।
সেনা সদরের তরফে যে সংবাদ সম্মেলন হয় সেখানে দৈনিক আমার দেশের বিরুদ্ধে এই মামলার প্রসঙ্গ ওঠে নি। তবে সংবাদ সম্মেলনে ৩ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে দৈনিক আমার দেশের প্রতিবেদনটিকে ‘হলুদ সাংবাদিকতার অংশ’ হিশাবে অভিযুক্ত করা হয়। দৈনিক আমার দেশ অবশ্য তার পরদিনই এই অভিযোগের জবাব দেয়। এরপর সেনা সদর থেকে কোন উত্তর এসেছে বলে আমি দেখি নি।

এই তথ্যগুলো পাঠকদের আবার বলবার কারণ হচ্ছে সেনাবাহিনীর তরফে যারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন তারা নাগরিকদের উৎকণ্ঠার মূল জায়গা এবং সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের মৌলিক প্রশ্নগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পুরা ব্যাপারটিকেই ‘প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের ইন্ধনে অবসরপ্রাপ্ত এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় ধর্মান্ধ কর্মকর্তা কর্তৃক অন্যান্যদের ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিশঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করার একটি বিফল প্রয়াস’ হিশাবে হাজির করেছেন। পুরা ব্যাপারটি আরো প্রশ্নবোধক হয়ে পড়েছে ইকোনমিস্টকে দেওয়া সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টায় অভিযুক্ত বেসামরিক ব্যক্তি প্রবাসী ইশরাক আহমেদের সাক্ষাৎকারে।

ইশরাক আহমেদ ইকোনমিস্টকে বলেছেন- তিনি ধর্মান্ধ মৌলবাদী নন। ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দায়িত্বের সঙ্গে নিজের দেশকে স্বাধীন করতে তিনি লড়েছেন। তার বাড়ি থেকে মদ, ব্র্যান্ডি ও হুইস্কি জব্দ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অস্ত্র নয়। ইকোনমিস্ট বলছে- ইশরাক অনেক কথাই বলেছেন। তবে খুবই সম্ভব ও সুনির্দিষ্ট যে তথ্য তিনি জানিয়েছেন সেটা হোল- ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের সদস্যরা বাংলাদেশে তৎপর। এই সংস্থার সদস্যরা প্রায় দুই বছর থেকে বাংলাদেশী গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে অফিস করছে এবং সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগব্যবস্থাও কার্যকর রয়েছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক নজরদারি চালায় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর থেকে তাদের সন্দেহভাজনদের অপহরণ করে।

ইশরাক আহমেদ আরো বলেছেন, সরকার সেনা অভ্যুত্থানের কথা বললেও কোনো ট্রুপস ও গান মুভমেন্ট দেখাতে পারে নি।

ইকোনমিস্ট এই সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে জানান দিতে চেয়েছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ সেনা সদর তুলেছে এবং ভারতের আনন্দবাজারের মতো পত্রিকা রটনা করে যাচ্চে তার ভিত্তি দুর্বল। এই দিকটা প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে। আসলে কী ঘটেছে তা প্রকাশ ও প্রমাণের দায় সরকারের। আমরা আশা করব সেনাবাহিনী দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না। আমরা চাই বা না চাই এটা পরিষ্কার যে বাস্তব কারণেই দিল্লির আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরোধিতা বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান নির্ণায়ক হয়ে উঠতে বাধ্য। এর জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ভারত নীতিই দায়ী। মৌলবাদ বা ধর্মান্ধ জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

৩০ জানুয়ারি ২০১২। ১৭ মাঘ ১৪১৮। শ্যামলী।

ফরহাদ মজহার: কবি, দার্শনিক কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী
                     farhadmazhar@hotmail.com

রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের গোলামি বাংলাদেশের ‘নিয়তি’ হতে পারে না


২০১১-০৯-১৭

দিল্লি ও ঢাকার একটা নিশ্চয়-জ্ঞান হয়েছে। সেই জ্ঞান হোল বাংলাদেশ ও ভারতের ‘নিয়তি’ একই সূত্রে গাঁথা। ইংরেজিতে ব্যবহার করা হয়েছে shared destiny। এই নিয়তিবাদিতাকে আমরা ভবিষ্যত সম্পর্কে দুই দেশের একটা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি বা আশাভরসা হিশাবে ব্যাখ্যা করতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা বুঝাবার জন্য আলাদা একটি কথা ব্যবহার করা হয়েছে : common vision। তাহলে শেয়ার্ড ডেসটিনি কথাটার মানে অন্য কিছু নয়। দুইয়ের ‘নিয়তি’ এক ও অভিন্নÑ এই সুনির্দিষ্ট অর্থেই কথাটা বুঝতে হবে। নিশ্চিত করেই বলা হচ্ছে ভারত ছাড়া বা ভারতের বাইরে বাংলাদেশের আলাদা বা নিজস্ব কোন ‘নিয়তি’ নাই। আগামি দিনে ভারত যা হতে চায় বা হবে আমরাও তা-ই হব। যদি ভারত যা হতে চেয়েও পারবে না, সেই ব্যর্থতাও আমাদের ‘নিয়তি’ হয়ে উঠবে। ভারতের সফলতা শুধু নয়, দুর্দশাও আমাদের পরিণতি হবে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই কপালের লিখন একটাই। তাই কি? যদি তা-ই হয় তাহলে বাংলাদেশের আর আলাদা রাষ্ট্র হয়ে থেকে ঝামেলা বাঁধিয়ে লাভ কী? ভারতের অঙ্গীভূত হলেই তো সব কিছুই সরল হয়ে যায়।
সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে দিল্লি ও ঢাকা ১২ অনুচ্ছেদের যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বার করেছে তার মুখবন্ধে কথাটি বলা হয়েছে : ‘আমরা নিশ্চিত’ (convinced) হয়েই দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের সহযোগিতার চুক্তি করছি যা “‘উন্নয়ন’ ত্বরান্বিত করবে এবং দুটো দেশের ‘উন্নয়নের আকাক্সা, একই নিয়তি এবং শান্ত ও সমৃদ্ধ দণি এশিয়ার সাধারণ স্বপ্ন (vision) বাস্তবায়নে সম করে তুলবে”। ‘আকাক্সক্ষা’ ও ‘সাধারণ স্বপ্ন’ উল্লেখ করার পরে ‘একই নিয়তি’ কথা আলাদা ভাবে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর ‘উন্নয়নের আকাক্সা’-র মধ্যে মিল থাকতে পারে এবং দণি এশিয়াকে সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিশাবে গড়ে তোলার েেত্র উভয়ের একই স্বপ্ন থাকা অসঙ্গত কিছু নয়। কিন্তু ভারতের নিয়তির আমরা কিম্বা আমাদের নিয়তির ভারত অংশীদার এই সুনির্দিষ্ট চিন্তাও তাদের আছে এই দিকটা আমাদের জন্য নতুন। কূটনৈতিক বা দ্বিপাকি রাষ্ট্রনৈতিক চুক্তির দলিলে নিয়তিবাদী চিন্তা ঢুকে পড়াকে সহজ ভাবে নেবার উপায় নাই। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়তিবাদী ধারণা দিয়ে বোঝার কুসংস্কার ও অযৌক্তিকতার খটকা তো আছেই। চুক্তির পেছনে দুটো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্পর্ক সম্বন্ধে যে চিন্তা কাজ করেছে, সেই চিন্তার মতলবটা আসলে কী তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একটা অস্বস্তি তৈরি হয়।
ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট বা নতুন ধরণের এই নিয়তিবাদী চুক্তির অনুচ্ছেদ এক আমাদের জানাচ্ছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের করিডোর চুক্তি হয়ে গিয়েছে। কারণ এই চুক্তিতে উভয় দেশই ‘সম্মতি’ (HAVE AGREED...) জানিয়ে স্বার করেছে। যে ভাষায় সেটা লিখিত হয়েছে সেখানে বেশ মুনশিয়ানা আছে। বলা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সড়ক দিয়ে, রেলগাড়ি করে, অভ্যন্তরীণ নদীপথে, আকাশে উড়োজাহাজে করে এবং জাহাজে ‘বাণিজ্য’ করবে। তার জন্য দরকারি অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে, সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহার করা হবে, নানান কায়দায় পণ্য পরিবহন করা হবে এবং পরিবহনের উপায়গুলো ঠিকঠাক আছে কি না তার জন্য মানদণ্ডও তৈয়ার করবে। বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে চায়। এটা যে করিডোর দেওয়াই হচ্ছে তাতে যেন কোন সন্দেহ না থাকে তার জন্য বলা হয়েছে এই বাণিজ্য ‘দ্বিপাকি এবং উপ-আঞ্চলিক (sub-regional)’ হবে। অর্থাৎ তথাকথিত বাণিজ্যের ভূগোল ভারত, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় রাজ্যের মধ্যে সীমিত থাকবে।
এবার আমরা করিডোর চুক্তিটি ইংরাজিতে কিভাবে লেখা হয়েছে সেটা এখন পড়ে দেখতে পারি।
ARTICLE 1: “To promote trade, investment and economic cooperation, which is balanced, sustainable and builds prosperity in both countries. Both Parties shall take steps to narrow trade imbalances, remove progressively tariff and non-tariff barriers and facilitate trade, by road, rail, inland waterways, air and shipping. Both Parties will encourage the development of appropriate infrastructure, use of sea ports, multi-modal transportation and standardization of means of transport for bilateral as well as sub-regional use.”
এই ‘উপ-আঞ্চলিক’ কায়কারবার শুধু বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সাত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (sub-regional cooperation) হবে ‘physical connectivity’ বা ভূখণ্ডগত সংযোগের সুবিধা থেকে ফায়দা তোলার কাজে। একই ভাবে ফায়দা তোলা হবে বিদ্যুৎ খাত, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং ‘পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন’ মার্কা সুবিধা আদায়ের েেত্রও। সকল েেত্রই দুটো দেশ একসঙ্গে প্রকল্প বানাবে এবং যৌথ বিনিয়োগের ব্যবস্থা করবে। ভূখণ্ডগত সংযোগের ধারণাকে (physical connectivity) খুব নির্দোষ ভাববার সুযোগ নাই, বিশেষত যদি তাকে ‘উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার’ (sub-regional cooperation) ধারণার সঙ্গে এক করে ভাবা যায়। এর মধ্য দিয়ে দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা চিন্তার রণনীতি ও রণকৌশল ধরা পড়ে। দিল্লি চাইছে বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী যে-সাতটি রাজ্য আছে সব মিলিয়ে এই পুরা ‘উপ-অঞ্চল’কে ভৌগোলিক ভাবে অভিন্ন গণ্য করে তার তিনটি উদ্দেশ্য সাধন। প্রথমে তার নিজ দেশের বিদ্রোহ মোকাবিলা; দুই, চিনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কথা মনে রেখে সামরিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈয়ার এবং তিন, ‘উপ-অঞ্চল’ নামে ভূগোল ও প্রাকৃতিক সম্পদ এলাকার সমৃদ্ধিকে ভারতীয় পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফার কাজে খাটানো। আমরা জানি যে ইতোমধ্যেই সিলেটে ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সেটা আবার হচ্ছে ব্যক্তিগত খাত হিশাবে। সেখানে ভারতের বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ হবে বলে ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এবার ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের সাত নম্বর অনুচ্ছেদ ইংরাজিতে কিভাবে লেখা হয়েছে সেটা পড়ে দেখা দেখা যাক।
ARTICLE 7 : To harness the advantages of sub-regional cooperation in the power sector, water resources management, physical connectivity, environment and sustainable development for mutual advantage, including jointly developing and financing projects.
সাত অনুচ্ছেদের পরপরই আট অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “দুটো দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সহযোগিতা করবে”। এই ভাবে ‘জাতীয় স্বার্থ’ নিয়ে সাধারণ একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করাকে অর্থহীন মনে হতে পারে, কারণ যেকোন দ্বিপাকি চুক্তির ভিত্তি তো একমাত্র দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ রার জন্যই। অতএব আলাদা করে মুখবন্ধে না বলে হঠাৎ করে অন্য অনুচ্ছেদের মাঝখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’ কথার উল্লেখ ভিন্ন অর্থ বহন করে। এখানে ‘জাতীয় স্বার্থ’ বলতে সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের কথাই বলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, সেই েেত্র বাংলাদেশের ‘জাতীয় স্বার্থ’ মানে ভারতীয় স্বার্থেরই অধীন একটা ব্যাপার মাত্র। সেটা রা হবে দুটো দেশ যদি স্থিতিশীল বা ‘শান্তির পরিবেশ’ বহাল রাখে যা দুই দেশের ‘অভিন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন’ (inclusive economic growth and development) প্রক্রিয়া জারি রাখার জন্য দরকার। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে বাণিজ্য ঘাটতি বা কূটনৈতিক ভারসাম্যহীনতা রয়েছে সেটা কমানোর কথা এক নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে (narrow trade imbalances)। সেটা করা হবে ভারতকে করিডোর দিয়ে। তাহলে ‘অভিন্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া’ কথাটার মানে আলাদা। তার মানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতীয় অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া ও করার কথাই এখানে বলা হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিও সামরিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে। এর পরপরই নয় অনুচ্ছেদে সামরিক ও নিরাপত্তার কথা স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে এই ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টের উদ্দেশ্য দুই দেশের ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত উৎকণ্ঠার’ েেত্র পরস্পরের সহযোগিতা। বলা হয়েছে, ‘কোন পই অপরের জন্য তিকর কোন কাজে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না’। এর ইংরাজি ভাষ্য হচ্ছে এই রকম :
ARTICLE 9 : To cooperate on security issues of concern to each other while fully respecting each other’s sovereignty. Neither party shall allow the use of its territory for activities harmful to the other.
অনুচ্ছেদ এগারোতে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বিস্তার নিশ্চিত করবার জন্য এই সামরিক ও নিরাপত্তা চুক্তি আগামি দিনে আরো উঁচু স্তরে ‘উন্নীত, গভীর ও সম্প্রসারণ করা’-র জন্য সংশোধন করা যাবে। অর্থাৎ এখন চুক্তি যা আছে সেটাই শেষ নয়। আগামিতে আরো যুক্ত হবে।
এই চুক্তি থেকে ইচ্ছা করলেই বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারবে না। চুক্তির অধীনে যে যৌথ কমিশন (Joint Consultative Commission) গঠিত হবে ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেই কমিশনের কাছে আগে লিখিত ভাবে নোটিশ দিয়ে জানাতে হবে। বেরিয়ে আসার যে কারণ সেই লিখিত চিঠিতে দেওয়া হবে সেটা বাংলাদেশ বললেই গৃহীত হবে না। যৌথ কমিশন বাংলাদেশ ঠিক কি বেঠিক বলল তার বাছবিচার করবে। পরিস্থিতির মূল্যায়ন হবে। যৌথ কমিশন এই েেত্র একধরণের যৌথ সরকারের ভূমিকা পালন করবে। দুই রাষ্ট্রের ‘যৌথ সম্মতি’ ছাড়া বাংলাদেশের এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নাই। তর্কের খাতিরে বলা যায় চুক্তি অনুযায়ী ভারতেরও নাই। কিন্তু চুক্তি হয়েছে ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তার স্বার্থে, চুক্তি থেকে দিল্লির বেরিয়ে যাবার কোন যুক্তি নাই। অন্যদিকে দিল্লি সামরিক ও অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই শক্তিশালী। বাংলাদেশ চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারবে তারও কোন সম্ভাবনা নাই। যদি কোন কারণে সেটা সম্ভবও হয় তারপরেও এই চুক্তির অধীন যা কিছু করা হবে বা যেসব উদ্যোগ বা প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে সেই সব থেকে যাবে। সেখানে কোন হেরফের হবে না।
অনুচ্ছেদ বারো এটাও পরিষ্কার করে বলছে যে, যেদিন এই চুক্তি স্বারিত হয়েছে সেদিন থেকেই সেটা বলবৎ হয়েছে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ থেকেই এই চুক্তি বলবৎ হয়ে গিয়েছে। ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট কোন প্রস্তাব নয়। এটা এখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বলবৎ চুক্তি। এই দিকটা বুঝতে পারা বাংলাদেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চুক্তি প্রণয়নের প্রক্রিয়ার দিকে যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে এই চুক্তি একান্তই শেখ হাসিনার নিজস্ব এজেন্ডা। যার কারণে তিনি পুরা কাজটিই করেছেন তার দুই উপদেষ্টার মাধ্যমে। তাকে দিয়ে এই চুক্তি করিয়ে নেবার পর এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পওে আর তিস্তার পানি পাইনি বলে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। এই ফাঁদে শেখ হাসিনা নিজেই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন। তিনি তিস্তার পানি আদৌ পান কি না সেটাই সন্দেহ। যদি আদৌ পান তবে সেটা হবে ভারতীয় শর্তে এবং তাকে সেটা হজম করতে হবে। এখন পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই শেখ হাসিনাকে দিয়ে এই চুক্তি করিয়ে নেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। চুক্তি স্বার করবার পর মুহূর্ত থেকেই শেখ হাসিনা ও তার দুই উপদেষ্টার হাত থেকে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার মতা জয়েন্ট কন্সালটেটিভ কমিশনের হাতে চলে গিয়েছে। বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই ধরনের কোন কমিশন এখনো গঠিতই হয় নি। স্বচ্ছভাবে দেনদরবার শলাপরামর্শ করার জন্য আগেই কোন যৌথ কমিশন বা দ্বিপাকি পরামর্শ কমিশন গঠন করা হয় নি। এখন যৌথ কমিশনের নামে মূলত ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ রার জন্য এক ধরণের ‘যৌথ সরকার’ গঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর দিল্লির সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারকে স্বার করে এসেছেন, তখন থেকেই আমি বারবারই বলে এসেছি দিল্লি বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী চায় না। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির সামরিক ও নিরাপত্তা নীতির গোলামি করুক এটাই প্রধান উদ্দেশ্য। জানুয়ারি দুই হাজার দশে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তারও ভারকেন্দ্র ছিল ভারতের সামরিক ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। গোলামির দাসখৎ হিশাবেই ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট-কে দেখতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে পরাশক্তি
হিশাবে ভারতের আবির্ভাবের দৃশ্যমান প্রমাণ হয়ে উঠেছে এই চুক্তি।
এখন প্রশ্ন উঠবে দিল্লির গোলামিতে কি আমাদের কোনই উপকার নাই? অবশ্যই আছে। ইংরেজের দুই শ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের কোন ফল কি আমরা পাই নি? অবশ্যই পেয়েছি। রেলপথ হয়েছে, টেলিগ্রাফ হয়েছে, ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা পেয়েছি আমরা, ইংরাজি শিায় শিতি হয়েছি। মনিব হিশাবে দিল্লি ইংরাজের চরিত্র নিয়ে হাজির হবে না ঠিক, কিন্তু দিল্লির গোলামি করে একদমই ফায়দা নাই, এই দাবি আমি করবো না। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি আদৌ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র? আমরা কি রাজনৈতিক ভাবে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী গণ্য করি, নাকি করি না? আমাদের কি কোন রাজনৈতিক ইতিহাস ও অস্তিত্ব বলে কিছু নাই? ইংরাজের এত অবদানের পরেও এই দেশে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল, জমিদার-মহাজন-ইংরাজের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল এবং ইংরাজ সেই স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছিল। দিল্লির বিরুদ্ধেও হবে। সেটা আগামি দিনে আমরা দেখব। এর অন্যথা হবে বলে মনে করবার কোন কারণ নাই। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে নব্য আঞ্চলিক গোলামির নতুন ঐতিহাসিক কালপর্বে আমরা প্রবেশ করলাম। দিল্লির গোলামির তত্ত্ব এই কথা বলে ফেরি করা হয় যে বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় হবে না সেটা হবে অর্থনৈতিক। দিল্লির সঙ্গে আমাদের আদানপ্রদানে আমাদের খালি অর্থনৈতিক হিসাব কিতাব করতে হবে। আমরা যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এই সত্য আমাদের ভুলে যেতে হবে। যারা আমাদের এই সত্য ভুলিয়ে দেবার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছেন তাদের চিনতে আমাদের ভুল হওয়া উচিত নয়।
এই চুক্তি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও তার পে কোন জনমত নাই এটা বলা যাবে না। বাংলাদেশে অবশ্যই দিল্লির অর্থনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তার স্বার্থ রা করবার লোকের অভাব নাই। এই ধারা দিল্লির গোলামির পে জনমত তৈরি করবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করছে যে ভারতের বিরোধিতা করা হয় সাম্প্রদায়িক প্রণোদনায়। ভারতীয় ‘জুজু’-র ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে দিল্লির পরাধীন করবার মহৎ উদ্দেশ্যে নাকি বাগড়া দেওয়া হয়েছে। জনগণ দিল্লির সদিচ্ছা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছে। এখন আমাদের অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করবার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেকোন মূল্যে হোক বাংলাদেশকে দিল্লির শাসকদের হাতে তুলে দিতে হবে। এর মধ্য দিয়েই দুই দেশের ‘ঐতিহাসিক’ সম্পর্কের গুণগত উত্তরণ ঘটবে। সাম্প্রদায়িকতারও পরাজয় ঘটবে। এরা প্রচার করে বেড়াচ্ছিল যে বাংলাদেশ যদি ভারতের নিরাপত্তাসংক্রান্ত উৎকণ্ঠায় ঠিকভাবে সাড়া দেয় এবং বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য যে সকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী লড়াই করছে তাদের বাংলাদেশে জায়গা না দেয় এবং দিল্লির হাতে তুলে দেয়, তাহলে দিল্লির কাছে আমরা যা চাইব তাই পাবো। দিল্লির নিরাপত্তা বিভাগের কাজ অবশ্য গত বছর শেখ হাসিনা দিল্লি যাবার আগেই সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু পালটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এলেন তখন বাংলাদেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল চাওয়াটাই শেখ হাসিনা পেলেন না। ড. মনোমোহন দিতে পারলেন না। তিস্তার পানি পাওয়া গেল না। শুধু দুঃখ প্রকাশ করলেন। দোষ চাপালেন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ওপর। বাংলাদেশের অধিকার, যেমন তিনবিঘা করিডোর পাওয়া, সেটাও আমরা পাই নি। বরং কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হবে। এটা কে চেয়েছে? তিনবিঘা চাইবার বিষয় নয়। দিল্লি যেন আমাদের দয়া করছে। ভারতের সঙ্গে এই ব্যাপারে চুক্তি হয়ে আছে এবং চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করলেও ভারত তিনবিঘা দিচ্ছে না। সেটা দিল না তো দিলই না। এবারও দিল না। এখন আবার খবর কাগজে দেখলাম সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে।
অতীতে ভারতের বিরোধিতার পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কাজ করে নি, এটা আমরা বলি না। এখনো নাই এই সাফাই গাওয়াও অর্থহীন। ভারতের হিংস্র হিন্দুত্ববাদ ও প্রকট সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে অনেক সময় কাজ করে। কিন্তু সেটা সবসময় গৌণ একটি ধারা। বাংলাদেশের জনগণ এ �

বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১২

গাদ্দাফিকে ন্যাটো হত্যা করেছে

ফরহাদ মজহার

farhad-mazhar-121121পাঁচদিন পর মোয়াম্মার গাদ্দাফি ও তাঁর ছেলে মোয়াতাসিম গাদ্দাফির লাশ দাফন হয়েছে বলে লিবিয়ার ন্যাশনাল ট্রানজিশানাল কাউন্সিল(এনটিসি) জানিয়েছে। তিনি জীবিত ধরা পড়েছিলেন অক্টোবরের ২১ তারিখ বৃহস্পতিবারে। তার দাফন হোল ২৫ তারিখ মঙ্গলবার। তবে কোথায় তাকে পুঁতে ফেলা হোল জানানো হয় নি। শেষমেষ গাদ্দাফির স্থান হোল অজ্ঞাতস্থানে । লিবিয়ায় কোথাও কোন মরুভূমির বালুর নীচে তার শেষ বিছানা সাব্যস্ত হোল। গাদ্দাফিকে সমালোচনা করবার ও তার বিরোধিতা করবার বিস্তর কারন থাকতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্যের সামরিক আগ্রাসন তাকে যেভাবে অপসারণ ও শেষাবধি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল এবং পাঁচ দিন লাশ পচিয়ে অজ্ঞাত স্থানে পুঁতল, আগাগোড়াই তা অতিশয় ঘৃণ্য একটি অপরাধের নজির হয়ে উঠেছে। গাদ্দাফিকে সমালোচনা করবার কথা, কিন্তু তার হত্যার প্রতিবাদ জানাবার জন্যই এই লেখা লিখতে হচ্ছে এখন। পুরা আগ্রাসনই চালানো হয়েছে মানবিকতার নামে , যাকে ইংরেজিতে হিউমেনিটেরিয়ান ইন্টারভেনশান বলা হয়। পুরা কুকর্মটি করা হলো গণতন্ত্র কায়েমের কেচ্ছা গেয়ে।
আহত কিন্তু জীবিত ধরা পড়েছিলেন গাদ্দাফি। পরে পিটিয়ে ও গুলি করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাঁর ছেলেকেও জীবিত ধরে বন্দী অবস্থায় গুলি করে মারা হয়েছে। পাঁচদিন ধরে মিসরাতা শহরের মাংস রাখার একটি হিমঘরে দুজনের লাশ রাখা হয়েছিল। লাইন ধরে মানুষ লাশ দেখেছে। লাশে পচন ধরেছে বলেও খবর বেরিয়েছে। তাঁর লাশ স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া অথবা ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা সেই সবে কান দেয় নি। তাকে তারা এমনভাবে পুঁতে ফেলতে চেয়েছে যাতে তার চিহ্ন কেউ খুঁজে না পায়। মৃত গাদ্দাফিও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। এই ভীতি কাজ করেছে। অতএব চিহ্নহীন অজ্ঞাত স্থানেই তাকে গেঁড়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে তারা।
বিদ্রোহী ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়ার প্রতিনিধি। বাংলাদেশও এই স্বীকৃতি দানের ভিড়ে শামিল। লিবিয়ায় গাদ্দাফির বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে আন্তর্জাতিক সমর্থনে এবং ন্যাটোর সামরিক সহায়তায়। দাবি করা হয়েছিল গাদ্দাফি বা তার পরিবারের কাউকে হত্যা ন্যাটোর বিমান হামলা ও সামরিক সহায়তার উদ্দেশ্য নয়। গাদ্দাফিকে সশস্ত্র যুদ্ধে উৎখাতের সমর্থন আছে, কিন্তু তাকে হত্যার অনুমোদন নাই। কিন্তু এখন তো তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কেন মেরে ফেলা হলো? হত্যার বৈধতা নিয়ে এখন তর্ক চলছে। দ্বিতীয় জটিলতা তৈরি হয়েছে যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধান নিয়ে। তৃতীয় জেনেভা কনভেনশানের ১৩ অনুচ্ছেদ বলে, “যুদ্ধবন্দীদের অবশ্যই সবসময়ই রক্ষা করতে হবে, বিশেষত তাদের প্রতি সহিংসতা প্রদর্শন ও ভয়ভীতি দেখানোর বিরুদ্ধে এবং অপমান ও মানুষের কৌতুহলের হাত থেকে”। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশানের ২৭ অনুচ্ছেদ আরো বিস্তৃত করে বলছে, “সকল পরিস্থিতিতেই রক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিত্বের সম্মান, মর্যাদা, পারিবারিক অধিকার, ধর্মীয় বিশ্বাস, চর্চা এবং তার আচরণ ও বিধান অনুসরণের অধিকার ভোগ করবেন। সবসময়ই তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে, বিশেষভাবে সকল ধরনের সহিংসতার কবল থেকে বা ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং অপমান করা ও মানুষের কৌতুহলের শিকারে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে”। বলাবাহুল্য গাদ্দাফি, তার ছেলে মোয়াতাসিম ও তার সমর্থক অনেকের ক্ষেত্রে জেনিভা কনভেনশান লঙ্ঘিত হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি গাদ্দাফির লাশ দেখতে চেয়েছিল। গাদ্দাফি হত্যা যুদ্ধাপরাধ কিনা এই পশ্ন উঠেছে। যদি যুদ্ধাপরাধ হয় তাহলে তা আমলে নেওয়া আইসিসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। কোন হত্যাকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ হতে হলে প্রথম বিচার্য যেখানে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেখানে যুদ্ধ চলছিল কিনা। লিবিয়ায় অবশ্যই যুদ্ধ চলছিল। দ্বিতীয় বিচার্য হচ্ছে যুদ্ধ করছে এমন কেউ আত্মসমর্পন করার পর নিরস্ত্র অবস্থায় তাকে মারা হয়েছে কিনা। এর উত্তর হচ্ছে অবশ্যই মারা হয়েছে। ধরা পড়ার পর নিরস্ত্র ও বন্দী অবস্থায় গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়েছে। আইসিসির যুদ্ধাপরাধের অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী, “কোন যোদ্ধা তার অস্ত্র ত্যাগ করে ফেলার পর, বা যখন নিজেকে রক্ষা করবার কোন উপায় না রেখে সে স্বেচ্ছায় আত্ম-সমর্পন করে তখন তাকে আহত বা হত্যা করা” যুদ্ধাপরাধ হিশাবে গণ্য হবে। কথা হলো, যুদ্ধাপরাধ কেবল একপক্ষের হয় না। গাদ্দাফি ও তার বাহিনীর ক্ষেত্রে আইসিসির বিধান যেমন খাটে, ঠিক তেমনি সেটা এনটিসি ও বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রেও খাটে।
গাদ্দাফিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তাতে মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে এবং এই হত্যা যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে। যেসব ভিডিওগুলো এখন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে এবং ইউটিউবে ঘুরছে সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে গাদ্দাফি ও তার ছেলে উভয়েই জীবন্তই ধরা পড়েছিলেন। বোঝা যাচ্ছে তাদের রক্ষা না করে জীবন্ত অবস্থাতেই মেরে ফেলা হয়েছে। কীভাবে মারা হোল সেই মুহূর্তগুলো সম্পর্কে এখনও পুরাপুরি জানা যায় নি, কিন্তু নিরস্ত্র বন্দী অবস্থাতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে এটা নিশ্চিত। এই দায় থেকে ন্যাটো ও এনটিসি সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে না। জীবন্ত মানুষ কী করে লাশ হয়ে গেল তার একটা তদন্তের দাবি উঠেছে। যেহেতু জেনেভা কনভেনশানের লংঘন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে অতএব ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দেবার দায়ও তৈরি হয়েছে। বলাবাহুল্য, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো জেনেভা কনভেনশানে স্বীকৃত অধিকার ও আইসিসির সংজ্ঞা অনুযায়ী ওয়ারক্রাইম বা যুদ্ধাপরাধ নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু এতে মনে করবার কোন কারন নাই যে এ নিয়ে বড় কোন হৈ চৈ হবে। বড় জোর জাতিসংঘ, ন্যাটো ও লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো একটু বিব্রত হবে মাত্র । তবে সেটা সাময়িক। লোক দেখানোর বেশি কিছু হবে না।
বিষয়টি এতোটুকুতেই শেষ হয়ে যাবে। একটু বিব্রত হওয়া, একটু অস্বস্তি, এতোটুকুই। আইসিসিও এই ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে জেনেও এই অপরাধকে আমলে নেবে না।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধেরএই দায় থেকে কী ব্যাখ্যা দিয়ে ন্যাটো বেরিয়ে আসে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে গাদ্দাফির হত্যার সঙ্গে ন্যাটো সরাসরি জড়িত–এই সত্য ক্রমশ জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো তাতে আদৌ বিচলিত বলে মনে হয় না। বরং ন্যাটোর তিনটি দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে গাদ্দাফিকে হত্যা করার কৃতিত্বটা কার বেশি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন নাকি ফ্রান্সের? এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে লিবিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর যুদ্ধের অবসান হয়েছে, এটা এক বিরাট সাফল্য হিশাবে প্রত্যেকেই দাবি করতে চায়। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের একটি রিপোর্টে (DEBKAfiles) বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকার করতে রাজী যে গাদ্দাফি সির্তেতে যে বাড়িতে ছিলেন সেই বাড়িটি লাস ভেগাসে বসে তাদের বৈমানিকরা ড্রোন দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দুই সপ্তাহ নজরদারিতে রেখেছিল আর বাড়ীটির চারদিক ব্রিটিশ আর মার্কিন সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছিল যাতে গাদ্দাফি বেরুতে না পারে। তার মানে ভুমিতে ন্যাটো সেনাবাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। অথচ ন্যাটো বারবারই দাবি করে আসছে ভূমিতে তাদের কোন সৈন্য যুদ্ধে অংশগ্রহন করছে না। যুদ্ধে ন্যাটো সেনাবাহিনী্র অংশগ্রহণ করার অর্থ লিবিয়া সংক্রান্ত জাতিসংঘের ম্যান্ডেট লঙ্ঘন করা।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ বলছে গাদ্দাফি যে একটি গাড়ির বহরে আছে সেটা একটি বৃটিশ গোয়েন্দা বিমান (USAF River Joint RC-135V/W intelligence signals plane) প্রথমে শনাক্ত করে, তারপর সেই খবর চাউর করে দেয় একটি ফরাসি যুদ্ধবিমানে আর সেই ফরাসি বিমান থেকেই গাদ্দাফির গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। ইসরায়েলি এই গোয়েন্দা ওয়েবসাইট এটাও দাবি করে যে জার্মান গুপ্তচর সংস্থা (Bundesnachrichtendienst ) গাদ্দাফি কোথায় আছে সেই তথ্য জোগাড় করবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ ন্যাটো সরাসরি ভূমিযুদ্ধে যেমন অংশগ্রহণ করেছে, তেমনি গাদ্দাফিকে হত্যার ক্ষেত্রেও সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ন্যাটো মানবাধিকার যেমন লঙ্ঘন করেছে, ঠিক তেমনি যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধে অপরাধীও হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এই অপরাধের জন্য ন্যাটোকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী হিশাবে ন্যাটোকে চিহ্নিত করে রাখা আমাদের জন্য দরকার।
লিবিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে তা একজন একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লিবীয় জনগণের গণতান্ত্রিক বিদ্রোহ বা বিপ্লবী যুদ্ধ হিশাবে দেখাবার তামাশায় আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই। লিবিয়ায় যা ঘটেছে তা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। গাদ্দাফির বিরোধীরা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে স্থানীয় সহযোগী হিশাবে ব্যবহৃত হয়েছে। গাদ্দাফিকে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে উৎখাত করবার সম্ভাবনা ছিল কি ছিল না সেই তর্ক এখন করে আর লাভ নাই। যদি তেমন কোন সম্ভাবনা আদৌ থেকে থাকে তবে সেটা দানা বাঁধবার আগেই সেটা হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্য সমর্থক সশস্ত্র কিছু গোষ্ঠির সরকার উৎখাতের লড়াই। তেলের ওপর দখলদারি প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা। গোষ্ঠ ও গোত্রের যুদ্ধ।
ইসরায়েলি ওয়েবসাইটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে ত্রিপোলি যাদের নিয়ন্ত্রনে তাদের মধ্যে রয়েছে সাবেক আল কায়দা নেতা আবদেল হাকিম বেলহাজ এবং লিবিয়ার মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ইসমাইল ও আলী আল-সাল্লাবি। তারা এনটিসির নেতা আব্দুল জলিলকে ত্রিপোলিতে একটি বিজয় র‍্যালী করতে এই শর্তে অনুমতি দিয়েছে যে তিনি ঘোষণা করবেন নতুন লিবিয়া হবে একটি শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র। এনটিসি সেটাই ঘোষণা করেছে। তারা আরও দাবি করছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের ‘আরব বসন্ত’ উসকিয়ে দেবার পেছনে প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোকে হঠিয়ে সেখানে শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম। লিবিয়াকে তারা নজির হিশাবে হাজির করছে।
গাদ্দাফির বিরুদ্ধে তার দেশের মানুষের ক্ষোভ ছিল, কিন্তু তার সমর্থকও কম ছিল না। গাদ্দাফির তিন রূপের সঙ্গে আমরা পরিচিত। তাঁর তরুন বিপ্লবী রূপ। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির নেতা হিশাবে তার আবির্ভাবের কাল (১৯৬০ – ১৯৮৮)। এই সেই গাদ্দাফি যিনি তার দেশের জ্বালানি সম্পদের আয় অর্থাৎ তেলের টাকার একটা অংশ লিবিয়ার জনগণের জন্য ব্যয় করেছেন। লিবীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। আরব ও আফ্রিকার দেশের জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আকাংখায় প্রেরণা জুগিয়েছেন। তার চিন্তা ও কাজের পদ্ধতি সুসঙ্গত ছিল এটা দাবি করা যাবে না। এরপর আরেক গাদ্দাফিকে আমরা দেখি যিনি পাশ্চাত্যের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, অবাধ বাজার ব্যবস্থার নীতি মেনে নিচ্ছেন। ভোগবিলাসে অনুরক্ত হয়ে উঠছেন। তৃতীয় যে রূপ দেখি সেটা হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে পাশ্চাত্য শক্তির সহায়তাকারী বনে যাওয়া। কিন্তু এই শেষের পরিবর্তন তাকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে পারলো না। তাকে মরতেই হোল।
নগ্নভাবে জাতিসংঘের প্রস্তাব লঙ্ঘন, মানবাধিকার বুটের তলায় পিষে ফেলা এবং সহাস্যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করা –এই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের আরেক কুৎসিত চেহারা যা আমাদের সবসময়ই মনে রাখা উচিত। গাদ্দাফিকে যেভাবে হত্যা করা হলো তার মধ্য দিয়ে এই চেহারাই গলিত লাশের মত আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একে যেন আমরা চিনতে ভুল না করি।
২৫ অক্টোবর ২০১১। ১০ ককার্তিক ১৪১৮। শ্যামলী।
ফরহাদ মজহার : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।